জাতীয়

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-আগুন, শঙ্কায় কর্মীরা

গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী সরকারের সুবিধা নেওয়া কোম্পানি কিংবা মন্ত্রী-এমপি, নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রধান টার্গেট ছিল দুর্বৃত্তদের। এই লুটপাট এখনো থামেনি। যার প্রভাব পড়ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। বিশেষ করে আতঙ্কে আছেন হাজারো কর্মী। কাজ হারানোর শঙ্কায় দিন কাটছে তাদের।

Advertisement

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেশের সম্পদ। ব্যক্তিগতভাবে কেউ এটা গড়ে তুলতে পারে, পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিন্তু এটা সবার সম্পদ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি মানে দেশের ক্ষতি। ফলে এমন হামলা মোটেই কাম্য নয়। এতে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

ঢাকায় অবস্থিত অনেক কোম্পানির প্রধান অফিসও এখন বন্ধ। এমন একটি কোম্পানির কর্মী ফয়সল আহম্মেদ। কোম্পানিটি ভবিষ্যতে চলবে, নাকি বন্ধ হয়ে যাবে- সেটাও এখনো অজানা তার।

আগেও সরকার পরিবর্তনের পর অনেক প্রতিহিংসার ঘটনা দেখেছি। তবে এবার সহিংসতা বেশি হচ্ছে। অনেকে লুটপাট করার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টার্গেট বানিয়েছে।- এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন

Advertisement

ফয়সাল এখন দারুণ দুশ্চিন্তায় তার চাকরি ও পরিবার নিয়ে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কখনো রাজনীতি না করলেও এখন আমি ক্ষতিগ্রস্ত। চাকরি আছে কি নেই, সেটাও জানি না। পরিবার নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।’

তিনি বলেন, ‘কোম্পানির মালিকের রাজনৈতিক পরিচয় থাকায় পুরো প্রতিষ্ঠান হামলার শিকার হয়েছে। কিন্তু আমরা যারা কাজ হারিয়েছি, আমাদের তো কোনো দোষ ছিল না। এমন প্রতিহিংসার কারণে এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবো, ভাবিনি। দেশের এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন।’

ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পতন হয় হাসিনা সরকারের। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ৮ আগস্ট। এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি কারখানায় লুটপাট, ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে। গাজী, বেঙ্গল গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস, পরিবহনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় বহু প্রতিষ্ঠান হামলার শিকার। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকে আবার স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ফিরতে পারবে কি না সেটা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।

কিছু প্রতিষ্ঠান সংকট কিছুটা কাটিয়ে উৎপাদনে ফিরেছে। তবে দেশব্যাপী তাদের কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। তারা আগের মতো এত কর্মকর্তা-কর্মচারী রাখতে পারবেন কি না সেটাও চিন্তার বিষয়। ফলে ছাঁটাই ও চাকরি হারানোর আতঙ্কে আছেন অনেকে।

Advertisement

এমন পরিস্থিতে দেশের শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে আবারও উদ্বেগ জানিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেছেন, বাংলাদেশি পণ্যের বিদেশি ক্রেতাদের এখন মূল উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা। এখনো কিছু প্রতিষ্ঠান লুটপাট, হামলা ও আগুনের শিকার হচ্ছে।

এসব কারণে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কাজ হারাচ্ছে, বাড়ছে বেকারত্ব। আবার বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যাহত হবে নতুন নতুন বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা। অন্যদিকে যারা রয়েছেন এমন বিদেশি ক্রেতারা বিকল্প গন্তব্য খুঁজবেন। তাতেও পরোক্ষভাবে কাজ হারাবে অনেক মানুষ। সার্বিকভাবে অর্থনীতি বড় ক্ষতিতে পড়বে।

আরও পড়ুন ধ্বংসস্তূপ গাজী টায়ার কারখানা, মরদেহের অপেক্ষায় স্বজনরা স্থিতি আসেনি ব্যবসা-বাণিজ্যে পুলিশের ‘দেখা নেই’, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি-লুটপাট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগেও সরকার পরিবর্তনের পর অনেক প্রতিহিংসার ঘটনা দেখেছি। তবে এবার সহিংসতা বেশি হচ্ছে। অনেকে লুটপাট করার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টার্গেট বানিয়েছে।’

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেশের সম্পদ। ব্যক্তিগতভাবে কেউ এটা গড়ে তুলতে পারে, পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিন্তু এটা সবার সম্পদ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি মানে দেশের ক্ষতি। ফলে এমন হামলা মোটেই কাম্য নয়।’

তিনি বলেন, ‘বেশকিছু পোশাক কারখানায় হামলা হয়েছে। এতে বিদেশে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এভাবে আমরা বিদেশি ক্রেতা হারাবো।’

বেশকিছু পোশাক কারখানায় হামলা হয়েছে। এতে বিদেশে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এভাবে আমরা বিদেশি ক্রেতা হারাবো।- বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর হচ্ছে এতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে, সাধারণ জনগণের ক্ষতি হচ্ছে।’

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পরে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপে দুই দফা হামলা, লুটপাট ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় দুটি কারখানা লক্ষ্য করে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এরপর গত ২৫-২৬ আগস্ট গাজী অটো টায়ারে আবারও আগুন দেওয়া হয়।

এফবিসিসিআইকে চিঠির মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানটি জানায়, হামলায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এতে আড়াই হাজারের বেশি কর্মী বেকার হয়ে পড়েছে। একই ধরনের ঘটনায় গত ৪ আগস্ট গাজীপুরে বেঙ্গল পলিমার ওয়্যারস, বেঙ্গল পলি অ্যান্ড পেপার স্যাক লিমিটেড ও বেঙ্গল ফ্লেক্সিপ্যাক লিমিটেডসহ বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সব প্রতিষ্ঠানে হয়েছে। এ হামলায় প্রায় ৪৬২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি প্রতিষ্ঠানটির।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে দেশে বেশ কিছু শিল্পগ্রুপের কারখানা এখন বন্ধ। সেসব কোম্পানির পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না। যার প্রভাব বাজারে পড়ছে। আবার যেসব কোম্পানি স্বাভাবিকভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের পণ্য সরবরাহকারী অনেক পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের মালিকও বিগত সরকারের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী হওয়ায় এখনো তারা ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। ফলে সারাদেশে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে কিছু কোম্পানির। সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও তাদের পরিবেশকরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। তারাও তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারছেন না।

এদিকে ৪ আগস্ট আশুলিয়ায় সিনহা টেক্সটাইলসহ বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে আরও আছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো সিনথেটিক। এটি বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যতম লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এমনকি হা-মীম গ্রুপের গোডাউন, সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের গুদাম, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও ঢাকা-১৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের মালিকানাধীন এসএস অ্যাগ্রো কমপ্লেক্সেও হামলা হয়েছে।

ধামরাইয়ের বারাকৈর এলাকায় গত ৫ আগস্ট থেকে টানা তিনদিন লুটপাট চালিয়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকার পাঁচ শতাধিক গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, হরিণ, পাখি, হাঁস, মাছ ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

এদের মধ্যে একটি ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে, আবারও সেটি চালু করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছি। চালু হলেও আগের মতো আর্থিক সচ্ছলতা থাকবে না। কর্মী ছাঁটাই ও বিপণন বাধাগ্রস্ত হবে।’

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালানোর পর দেশজুড়ে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও লুট হয়। একজন ব্যবসায়ী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের এমন একটি পরিস্থিতি যে, কোন কোম্পানি থাকবে আর কোনটা থাকবে না এ শঙ্কায় ভুগছি। অনেক কোম্পানির সঙ্গে ডিলার ডিস্ট্রিবিউটরশিপও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।’

এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকায় বিগত সরকারের রাজনৈতিক কর্মী ও সুবিধা নেওয়া ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান, দোকান, খামার ও কৃষিপণ্য ধ্বংস ও অর্থ লুটপাটের মতো ঘটনা ঘটে চলছে। সার্বিক ক্ষতি হিসেবে নিলে এ ধরনের সহিংসতায় অনেক বড় ক্ষতি হচ্ছে দেশের।

এনএইচ/এএসএ/এএসএম