প্রবাস

প্রবাসীদের অবদান, প্রতিরক্ষা চ্যালেঞ্জ এবং উন্নতির পথ

বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঘনবসতিপূর্ণ ও উন্নয়নশীল দেশ, তার সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং উন্নয়ন প্রবণতার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে নজর কেড়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশটি নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আজকের উন্নত অবস্থানে পৌঁছেছে। এর উন্নয়নের পথে যাত্রা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিশ্বব্যাপী নানা প্রতিক্রিয়া এবং স্বীকৃতির জন্ম দিয়েছে। তবে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে কিছু চ্যালেঞ্জ ও অরাজকতা দেশটির ভাবমূর্তি এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলছে।

Advertisement

বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। দেড় কোটিরও বেশি বাংলাদেশি প্রবাসে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রায় এক কোটিরও বেশি রেমিট্যান্সযোদ্ধা প্রতিদিন দেশে অর্থ পাঠিয়ে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করছেন। এই রেমিট্যান্স শুধু পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করে না বরং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করে, যা জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সহায়তা করে। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশটি উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের সীমান্ত সমস্যাগুলো, বিশেষত ভারতের সঙ্গে, দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও পরিবেশের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে নদীগুলিতে জলপ্রবাহ কমে যাওয়া, বিশেষত বর্ষার সময় আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি করা, একটি বড় সমস্যা। ফারাক্কা বাঁধ থেকে বিনা নোটিশে জল ছেড়ে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল প্রায় প্রতি বছরই বন্যায় প্লাবিত হয়। এর ফলে কৃষি, জনজীবন ও অর্থনীতিতে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

এই সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিকভাবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি স্থায়ী সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে নতুন বাঁধের নির্মাণ ও মেরামতসহ প্রযুক্তিগত সমাধান খুঁজে বের করা যেতে পারে। একই সাথে বিজিপি সহ যে পরিমাণ প্রতিরক্ষা বাহিনী সীমানা পাহারা দিতে নিবেদিত এবং যে পরিমাণ চোরাচালানি, খুন এবং বৈষম্য বছরের পর বছর হয়ে আসছে, সেগুলো থেকে যেমন বাংলাদেশ রেহাই পাবে, একই সাথে স্বাধীন বাংলাদেশে তার নির্দিষ্ট গতি এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করে আগামী দিনগুলোতে এগিয়ে যাবে।

Advertisement

বাংলাদেশ রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি খাতে বৈশ্বিকভাবে সুনাম অর্জন করেছে। মাছ, সবজি, পাট, পোশাক, চামড়া এবং আরও কিছু খাতে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। এসব খাতে দক্ষ কর্মীর উপস্থিতি এবং উৎপাদনের মান উন্নত হওয়ায় বাংলাদেশকে একটি দক্ষ শিল্প কারখানা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে, এ সমস্ত সাফল্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে যদি দেশের কূটনৈতিক সংগঠনগুলি সঠিকভাবে এবং সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা বাড়াতে এবং নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য শক্তিশালী কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। কূটনৈতিক পর্যায়ে বাণিজ্য চুক্তি, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ, এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ তৈরি করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

দেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। পোশাক শিল্প, কৃষি, এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্নতি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি দেশের আত্মনির্ভরশীলতার সাথে সাথে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্নীতির সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের উন্নয়নের পথে বড় বাঁধা।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশেষভাবে প্রভাবিত একটি দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এবং লবণাক্ততার সমস্যা দেশের কৃষি এবং জনজীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া, বন উজাড়, বায়ু ও জল দূষণ, এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ পরিবেশগত সংকট সৃষ্টি করছে। এসব সমস্যা মোকাবিলায় দেশের উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন, এবং প্রতিবাদে অরাজকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধরনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।

Advertisement

দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিরোধী মতের প্রতি সরকারের কঠোর অবস্থান এবং বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সমালোচনা করেছে। এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে।

দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশগুলো বাংলাদেশের প্রতি তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখলেও, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে তাদের উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সহযোগিতা বজায় রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

তবে সর্বজনীন স্বীকৃতি অর্জনের জন্য যা করণীয় এবং বর্জনীয়;

১) অর্থনৈতিক সংস্কার: অবকাঠামো, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। দেশের বর্তমান উন্নয়ন ধারা বজায় রাখতে এবং বৈষম্য হ্রাস করতে এসব খাতে আরও সংস্কার প্রয়োজন।

২) সুশাসন ও মানবাধিকার: সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এ ধরনের পদক্ষেপ বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। ৩) পরিবেশ সংরক্ষণ: পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো জরুরি।

৪) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং গণতান্ত্রিক চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অরাজকতা এড়াতে সরকারকে জনমতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

৫) কূটনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধি: রপ্তানি খাতে সাফল্য বৃদ্ধির জন্য কূটনৈতিক সংগঠনগুলোর দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি, নতুন বাজার তৈরি এবং বিদ্যমান সম্পর্ক বজায় রাখতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরো সক্রিয় ও পরিকল্পিত হওয়া প্রয়োজন।

৬) নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ: বাংলাদেশের উন্নয়নে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অন-দ্য-জব ট্রেনিং-এর মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত, যেন তারা ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রশিক্ষণের জন্য একটি বেতনভাতা ব্যবস্থা চালু করা হলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উৎসাহ এবং উদ্দীপনা আরও বাড়বে। প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন প্রজন্মকে দেশ গঠনের কাজে যুক্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে, তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশ গঠনে তাদের ভূমিকা আরও শক্তিশালী হবে।

বর্জনীয় বিষয়সমূহ:

১) দুর্নীতি: দুর্নীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্তরায়। এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। দুর্নীতি দমনে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

২) অপর্যাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থা: শিক্ষা খাতে আরও উন্নয়ন প্রয়োজন। উচ্চমানের শিক্ষা প্রণালী এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গড়ে তোলা উচিত যেন দেশের নতুন প্রজন্ম দক্ষ এবং প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে।

৩) সামাজিক অস্থিরতা: সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। এ বিষয়ে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করা জরুরি।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কঠোর পরিশ্রম এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। একই সাথে, রপ্তানি খাতে দেশের অসাধারণ দক্ষতা এবং সম্ভাবনা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করছে। তবে, দেশের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং মানবাধিকার সংকট মোকাবিলা করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হবে।

দক্ষ কূটনৈতিক সংগঠনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আরও শক্তিশালী হতে পারে, যা বৈশ্বিক বাজারে দেশের স্থান আরও সুদৃঢ় করবে। নতুন প্রজন্মকে দেশ গঠনের কাজে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে। প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং তাদের জন্য অন-দ্য-জব ট্রেনিং এবং বেতনভাতার ব্যবস্থা করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব।এভাবে, দেশটি তার বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ভিত্তি মজবুত করে আগামী দিনগুলোতে আরও শক্তিশালীভাবে এগিয়ে যাবে।

রহমান মৃধাসাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন rahman.mridha@gmail.com

এমআরএম/এএসএম