খেলাধুলা

রাওয়ালপিন্ডিতে ঐতিহাসিক জয়ের পেছনের গল্প শোনালেন মুমিনুল

দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ সময় আর ১৩ টেস্টে যা সম্ভব হয়নি, এবার রাওয়ালপিন্ডিতে তাই হলো। টেস্টে আগে কখনোই পাকিস্তানকে হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। এবার হারালো, সেটাও আবার তাদেরই মাটিতে ১০ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে।

Advertisement

মুশফিকুর রহিম, সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, লিটন দাসের অসামান্য ব্যাটিং; মেহেদী হাসান মিরাজের দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্স এবং সাকিব আল হাসান ও তিন পেসার শরিফুল ইসলাম, নাহিদ রানা আর হাসান মাহমুদের বোলিংয়ের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারেনি শান মাসুদের পাকিস্তান। মুখ থুবড়ে পড়েছে।

প্রিয় জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের এমন চমক জাগানো পারফরম্যান্সে মুগ্ধ টাইগার সমর্থক ও ভক্তরা। প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, বিসিবি পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিম, খালেদ মাহমুদ সুজন, আকরাম খানের মতো তারকা ক্রিকেটবোদ্ধাসহ সবার কথা প্রায় একরকম- এত আলো ছড়ানো নৈপুণ্যের দ্যুতিতে ভরা বিরাট জয় আশা করেননি কেউ।

সত্যিই তাই। টেস্টে টিম বাংলাদেশের গড়পড়তা পারফরম্যান্স যা, তা দিয়ে জিম্বাবুয়ের মতো দলের বিপক্ষেও আগেভাগে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। এত আলো ঝলমলে পারফরম্যান্স ও অমন বড় জয়ের কথা ভাবা তো আরও কঠিন।

Advertisement

তাহলে এবার পাকিস্তানের মাটিতে মোহাম্মদ রিজওয়ান, বাবর আজম, শান মাসুদ, সৌদ শাকিল, শাহিন শাহ আফ্রিদি আর নাসিম শাহর পাকিস্তানকে এতটা নাকাল করলো কিভাবে? এ চমক জাগানো সাফল্যের পেছনের কাহিনী কী?

টিম বাংলাদেশের অন্যতম সদস্য এবং রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫০ রান করা মুমিনুল হক জাগো নিউজের সঙ্গে মুঠোফোন আলাপে শোনালেন এ সাফল্যের পেছনের গল্প। আসুন তার মুখ থেকেই শোনা যাক সে গল্প...

মুশফিক ভাইসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল

‘দেখেন, এমন একটা সাফল্য তো আর হুট করে আসেনি। এর পেছনে অবশ্যই একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছিল। আমি যদি সংক্ষেপে বলি, তাহলে বলবো- মুশফিক ভাই, সাদমান ইসলাম, লিটন দাস, মেহেদী হাসান মিরাজ আর আমার ব্যাটিং এবং ৫ বোলারের খুব ভালো বোলিংয়ের মিশেলে ধরা দিয়েছে এ জয়। সবাই তাই-ই বলছেন। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ যারা এই ম্যাচ মাঠে বসে কিংবা টিভিতে দেখেছেন, তারাও তাই বলবেন।’

Advertisement

‘এর মধ্যে কেউ কেউ হয়তো মুশফিক ভাইয়ের লম্বা চওড়া ইনিংসটাকে এগিয়ে রাখতে চাচ্ছেন। কারো কারো মত, মুশফিক ভাই এত দীর্ঘ সময় উইকেটে থেকে ১৯১ রানের লম্বা ইনিংস না খেললে সাদমানের ৯৩, মিরাজের ৭৭, আমার ৫০ আর লিটন দাসের ৫৬ রানের পরও হয়তো আমরা লিড পেতাম না। হ্যাঁ, এটা সত্য। মুশফিক ভাই একা প্রায় দুশো রান করে দেওয়ায় আমরা ১১৭ রানের লিড পেয়েছি। একটা কমান্ডিং সিচুয়েশন তৈরি হয়েছে এবং ওই লিডটাই আমাদের মাথায় জয়ের চিন্তা ঢুকিয়েছে।’

ওপেনিংয়ে সাদমানের দারুণ সূচনা

‘তাই বলে ওপেনার সাদমান ইসলামের ইনিংসটাকেও আপনি এতটুকু ছোট করে দেখতে পারবেন না। শুরুতে সাদমান অনেকক্ষণ উইকেটে থেকে খেলায় পাকিস্তানি ফাস্টবোলাররা আমাদের ওপর চেপে বসতে পারেনি।’

‘শাহিন শাহ আফ্রিদি ও নাসিম শাহর বোলিং তোড়টা প্রথম দিকে সামলেছে সাদমান। তাতে করে পাকিস্তানি পেসাররা শুরুতে আমাদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিতে পারেনি।’

মিডল অর্ডারের ভূমিকা

‘এরপর লিটন দাস স্বচ্ছন্দে হাত খুলে কিছুক্ষণ উইকেটের সামনে ও দুই দিকে ভালো শটস খেলায় পাকিস্তানি বোলারদের মনোবল ভেঙে যায়। আমিও রান করেছি। তাতে করে আমাদের ইনিংসটায় স্থিতি চলে আসে। মোটামুটি একটা মজবুত ভিতও গড়ে ওঠে।’

মুশফিক ভাইয়ের ইনিংসটি কখনো ভুলবো না

‘এরপর মুশফিক ভাই আর মিরাজ ইনিংসটাকে এগিয়ে নেন। মুশফিক ভাই খুব, খুব ভালো খেলেছেন। তার অনেকগুলো লম্বা ও বড় ইনিংস আছে। আমি প্রায় সবকটাই দেখেছি। সঙ্গীও ছিলাম বেশ কয়েকটার।’

‘কিন্তু এই ইনিংসটির কথা আমি কখনো ভুলবো না। আমার মনে হয় মুশফিক ভাইয়ের টেস্ট ক্যারিয়ারের ওয়ান অব দ্য বেস্ট ইনিংস। কী অসাধারণ খেললেন! যেন পণ করেই নেমেছিলেন, ‘একটা লম্বা চওড়া ইনিংস খেলবো। যতটা সম্ভব বেশি সময় উইকেটে থাকবো। ধৈর্য ধরে একপ্রান্ত আগলে রাখবো। পাশাপাশি রানের চাকাও সচল রাখবো।’ প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ় সংকল্প আর আত্মনিবেদন ছাড়া এমন সংগ্রামী ইনিংস খেলা অসম্ভব।’

মিরাজের সাপোর্ট

‘মিরাজও মুশফিক ভাইয়ের সাথে দলকে একটা মজবুত অবস্থানে পৌঁছে দিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তার সাপোর্টটাও খুব কাজে দিয়েছে। সব মিলে আমরা পাকিস্তানিদের ৪৪৮ রান টপকে ১১৭ রানে লিড পেয়েছি। বলতে পারেন, সেই লিডটা আমাদের ম্যাচ জয়ের বড় রসদ হিসেবে কাজ করেছে।’

বোলারদের অসাধরণ বোলিংয়ের রহস্য

‘আমরা মনে করেছি, এখন বোলাররা কারিশমা দেখালে কিছু একটা হতে পারে। আমরা জানতাম পঞ্চম দিনের উইকেট ভাঙবেই। চতুর্থ দিন শেষেই পিচে বড় বড় ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। প্রচণ্ড গরম ছিল। অসহ্য গরম, ভ্যাপসা গরম। এ গরমে পিচে ফাটল ধরা অস্বাভাবিক নয়।’

‘আমরা ধারণা করেছিলাম, উইকেটের ওই ফাটল কাজে লাগাতে পারলে পাকিস্তানি ব্যাটারদের চাপে ফেলা সম্ভব। সাকিব ভাই আর মিরাজ ঠিক তাই করেছে। তিন পেসার শরিফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ আর নাহিদ রানাও দারুণ ব্যাকআপ করেছে।’

‘আর তাতেই পাকিস্তানিরা দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৪৬ রানে অলআউট হয়। আমাদের সামনে দাড়ায় মাত্র ৩০ রানের জয়ের টার্গেট। ওই সামান্য কটা রানের টার্গেট টপকে যেতে হাতে ছিল প্রচুর সময়। আমরা বিনা উইকেটে লক্ষ্যে পৌঁছে যাই। পাই ১০ উইকেটের দারুণ এক জয়।’

‘সব মিলে সবার চেষ্টা, টিম ওয়ার্ক, টিম পারফরম্যান্স এবং সময়ের কাজগুলো সময়মত করতে পারার কারণেই দেখা মিললো এমন এক দারুণ জয়ের।’

টেস্টের জন্য কার্যকর প্রস্তুতি

‘কিন্তু এর বাইরেও কথা আছে। একটু পেছন থেকে চিন্তা করলে বলতে হবে, আমরা লাল বলে প্রায় ৩ মাস প্র্যাকটিস করেছি। মুশফিক ভাই, সাদমান, মিরাজ, আমি, জাকির, খালেদ, নাহিদ রানাসহ এই দলের অর্ধেকের বেশি খেলোয়াড় লাল বলে নিবিড় অনুশীলন করেছি।’

‘আমাদের আবাসিক ক্যাম্প হয়েছে সিলেট ও চট্টগ্রামে। সোহেল মামা (কোচ সোহেল ইসলাম) ও মিজানুর রহমান বাবুল ভাই আমাদের সাথে প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। আমরাও প্রাণপন চেষ্টা করেছি।’

‘ওই আড়াই মাসের বেশি সময়ের অনুশীলনটা খুব কাজে দিয়েছে। যেহেতু সেটা ছিল অফ-সিজনে, সাধারণত এসব প্র্যাকটিস ততটা সিরিয়াস হয় না। তবে এবারের লাল বলের সেই প্র্যাকটিস সেশনগুলো খুব সিরিয়াসলি হয়েছে। সবার একটা অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল। নিজেদের তৈরি করার সদিচ্ছা ছিল।’

স্থানীয় কোচদের নিবেদন

‘আর কোচিং স্টাফে সোহেল স্যার ও বাবুল স্যার সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন আমাদের স্কিল ডেভেলপ করতে। সেটাও সবার ভালো খেলার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। আর মাঠে কিছু ছোটখাটো বিষয় যদি ভালোমত খেয়াল করেন, দেখবেন আমরা ঠিকমত সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করেছি।’

ম্যাচে ঘটনার ভেতরে ঘটনা

‘যেমন দ্বিতীয় দিন পাকিস্তান ইনিংস ঘোষণার পর দুই ওপেনার জাকির আর সাদমান ১২ ওভার উইকেটে কাটিয়ে দিয়েছে স্বচ্ছন্দে খেলে। টেস্টে প্রায় দুদিন ফিল্ডিং করার পর আমরা শেষ ঘণ্টা বা ৪০-৪৫ মিনিট ব্যাটিং করে বহুবার ৩-৪ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে গেছি। অনেক ম্যাচেই অমন সময় ব্যাটিংয়ে নেমে বিপাকে পড়েছি। এবার সেটা হয়নি।’

প্রচণ্ড গরমে স্বাগতিকরাই ক্লান্ত হয়ে যায়

‘আমাদের দুই ওপেনার অপরাজিত থেকেই মাঠ ছেড়েছে। এরপর আমরা ১৬৭ ওভার ব্যাটিং করায় উল্টো পাকিস্তানিরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড গরম ছিল। ১৬৭ ওভার ফিল্ডিং করার পর ব্যাটিংয়ে নেমে স্বাভাবিক থাকা কঠিন। পাকিস্তানিরা তা পারেনি। ১ উইকেট হারিয়ে বসে চতুর্থ দিন শেষ আধ ঘণ্টায়। আর পঞ্চম দিন উইকেটে ফাটল ছিল। সেটা আমাদের বোলাররা কাজে লাগিয়েছে খুব ভালোভাবে।’

সাকিব ভাই ও মিরাজের বোলিং এবং আমাদের ফিল্ডিং

‘সাকিব ভাই আর মিরাজ দারুন লাইন ও লেন্থে বল ফেলেছে। পাকিস্তানিরা না রান করতে পেরেছে, না উইকেট রক্ষা করতে পেরেছে। এর বাইরে আরও একটি কথা বলবো, আমরা খুব ভালো ও ভাইটাল কিছু ক্যাচ ধরেছি। প্রথম দিন জাকির হাসান গালিতে যে অসামান্য দক্ষতায় ক্যাচ ধরেছে, সেটাও পুরো দলকে উজ্জীবিত করেছে। আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি।’

ব্যাটিংয়ে তাড়াহুড়ো না করা

‘সবচেয়ে বড় কথা আমরা ব্যাটাররা বাড়তি চাপ না নিয়ে যে যার স্টাইলে ব্যাটিং করেছি। সাদমান বেশি সময় উইকেটে থাকতে পছন্দ করে। সে সেটাই করেছে। এতটুকু তাড়াহুড়ো করেনি। যতটা সময় পারা যায়, ক্রিজে থাকার চেষ্টা ছিল তার।’

‘আমি আমার স্টাইলে খেলতে চেষ্টা করেছি। আলগা বলের অপেক্ষায় থেকে ভালো বলকে সমীহ করেই খেলতে চেষ্টা করেছি। লিটন দাস শটস খেলতে পছন্দ করে। খেলার ক্ষমতাও আছে। সে তার সে ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়েই নাসিম শাহর এক ওভারে ১ ছক্কা ও ৩ বাউন্ডারি হাঁকিয়েছে। সেটাও আমাদের ব্যাটারদের মনোবল, সাহস বাড়াতে সহায়তা করেছে।’

মুশফিক ভাইয়ের সংকল্পের কাছেই হার মেনেছে পাকিস্তান

‘মুশফিক ভাইয়ের লম্বা ইনিংস খেলার সংকল্পের কাছে হার মেনেছে পাকিস্তানি ফাস্টবোলারদের সব চেষ্টা। সাথে মিরাজও শেষ দিকে স্কোরলাইন বড় করার পথে দলকে সহায়তা করেছে। এরপর শেষ দিন আমাদের বোলাররা নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উইকেট বুঝে জায়গামত বল করে সাফল্য তুলে নিয়েছে। আর আমাদের ফাস্টবোলিং দিয়ে ঘায়েল করার চিন্তায় থাকা পাকিস্তানিরা নিজের ভুলে নিজেরাই পা দিয়েছে।’

এআরবি/এমএমআর/আএইচএস