‘যেকোনো মানুষের মৃত্যু আমাকে ছোট করেকেননা আমি মানবতার অংশআর তাই জিজ্ঞাসা করো না কার জন্যে বাজছে ঐ ঘণ্টাধ্বনি সে বাজছে তোমার জন্যে’। জন ডানের এই কবিতার মতো এখন সকলের ভাবনায় বড় জায়গা করে আছে মৃত্যু। একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় যারা উদার সংস্কৃতির চর্চা করেন, তাদের আতংক শুধু বাড়ছেই। একটি দুটি খুন করে করে যদি পার পেয়ে যায় খুনিরা তাহলে একটা সময় আসবে যখন তারা পাকিস্তানের মতো গণহত্যা শুরু করবে।বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব যারা খুঁজছে তারা যে মদদ দিয়ে যাচ্ছে তা নানাভাবে স্পষ্ট। কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেদের কোথায় নিয়ে চলেছি সে ভাবনা কি আছে? কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু বিচার না করে করে এমন এক জায়গায় পুরো পরিস্থিতি নিয়ে যাচ্ছি যে, কোনো ঘটনা ঘটলে এখন মানুষ বিচারও চাচ্ছে না। তবে তার চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠছে দায়িত্বশীল জায়গায় থাকা ব্যক্তিদের কথাবার্তা। একটি মানুষ খুন হওয়ার পর তিনি কি ছিলেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ, নাকি খুনের বিচার হওয়াটা জরুরি? বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভয়ংকর, কিন্তু তার চেয়েও বিপজ্জনক এমন দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি। পুলিশ প্রধান যখন বলেন ঘরে পাহারা দেয়া সম্ভব নয় কিংবা নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই নিতে হবে, তখন প্রশ্ন জাগে তাহলে তিনি আছেন কেন? তার বাহিনীই বা আছে কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, সমকামীতা আমাদের সমাজের সাথে যায় না, তখন প্রশ্ন জাগে হত্যা, ধর্ষণ কি আমাদের সমাজের সাথে যায়? একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলেও খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠছে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃংখলা বাহিনীর দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে। তবে সক্ষমতার চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে তাদের আন্তরিকতার প্রশ্নটি। সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য অজুহাত তৈরির প্রবণতা থেকে যদি খুনের বিচার না হয়, তবে এর শিকার হবে পুরো জাতি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলোর দায়িত্ব আইএস স্বীকার করেছে- এ অজুহাত দেখিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব খুঁজছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর রাখঢাক না করেই বলেছে, বাংলাদেশের সক্ষমতা নেই এসব মোকাবেলার, যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে প্রস্তুত। অনেকে মনে করছেন, আইএসের ধুয়া তুলে নানাভাবে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের অজুহাত তৈরির চেষ্টা এটি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সতর্ক থাকবো আমরা, সেটি প্রত্যাশিত। কিন্তু দৃষ্টি দিতে হবে নিজের গভীরে। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত সর্বত্রই দেখা গেছে জাতীয়তাবাদের নামে ধর্মকে যারাই আশ্রয় বানিয়েছে সেই আশ্রয় শেষ অবধি পতন ডেকে আনে। এটি ইতিহাসের শিক্ষা। বাংলাদেশের সমাজে একটা গোষ্ঠি ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করেছে, এখনো করছে। যারা রাষ্ট্রধর্ম করেছে, যারা বিসমিল্লাহ এসেছে তারা সৎ কোনো ধার্মিক কারণে করেনি কাজগুলো, করেছে কুৎসিক রাজনৈতিক কারণে। একইভাবে এ মুহূর্তে দেশ চালানোর জন্য হেফাজতের কোনো হুজুরের প্রশংসা বাক্য যে পাথেয় নয়, অভিশাপ তা মনে রাখতে হবে। মানবিক সমাজ গঠনের প্রথম শর্ত হলো ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা। সেই মত পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু শুনতে অসুবিধা কোথায়? আর খণ্ডন করার একমাত্র পথ যুক্তি ও তথ্য। আক্রমণ করে, হত্যা করে, আগুন দিয়ে তা করা যায় না। কিছু মানুষের মৃত্যু হয় ঠিকই, কিন্তু এতে করে কোনো পক্ষেরই তেমন কোনো উপকার হয় না, কোনো আদর্শেরই কোনো কিনারা হয় না। প্রথম আসে রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধের প্রশ্নটি। রাষ্ট্রের হাতে অনেক ক্ষমতা। আর তা আছে বলেই গণতন্ত্রের বিকাশের প্রয়োজনে রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তাদের আচরণে সহিষ্ণুতা প্রয়োজন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠিকে ভিন্নমত শুনবার ও তার সাথে যুক্তিনির্ভর বিতর্কে প্রবৃত্ত হবার আগ্রহই রাষ্ট্রকে শক্তি যোগায়। তাকে দমন করে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার কোনো কৃতিত্ব নেই। তেমনিভাবে সাহিত্য, সংস্কৃতির পরিমণ্ডলেও যুক্তিতর্কের চর্চা প্রত্যাশা করে গণতন্ত্রমনা মানুষ। ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার কারণে খুন করে যারা তারা অসাংস্কৃতিক। যারা একে সমর্থন করে, এতে শুধু সরকার বেকায়দায় পড়ছে বলে যারা উল্লাস করছে আজ, তাদের বিপদ এর চেয়েও বেশি হতে পারে আগামীতে। অসিহিষ্ণুতা অতি বিষম ব্যাধি। তা আরো ভয়ংকর হয় যখন তার সাথে যুক্ত হয় ধর্মীয় উন্মাদনা। রাষ্ট্রের প্রতি কারও আনুগত্যে সামান্য টান পড়লেই সে `রাষ্ট্রদ্রোহী`, সরকারি লোকজনের এই ভাবনা যেমন ভুল, তেমনি যারা রাষ্ট্রের বাইরে থেকে বিভিন্ন ভিন্নমতাবলম্বীকে খুন করায় মেতে উঠেছেন তারাও ব্যাধির নিরাময় নয়, ব্যাধি লালনের চর্চা করছেন। সমাজে অশিক্ষা ও অহংকার গাঁটছড়া বাঁধলে দেশের মহাবিপদ। আইএস থাকুক বা না থাকুক, দেশে স্থানীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা আছে। আইএস যদি সত্যিই এ দেশে তৎপরতা চালাতে চায়, তাহলে তা চালাবে এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর মাধ্যমেই। কারণ এ সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে আইএসের আদর্শিক সহযোগী। সেক্ষেত্রে দেশে জঙ্গি তৎপরতা মোকাবেলা করাটা জরুরি। আর এজন্যই প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। অপরাধী যারাই হোক, বিষয়টিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বদলে আইনগতভাবে এর সমাধান করতে হবে। আর এ কাজটি করতে হবে আমাদের নিজেদেরই। এবং তা করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা বিরোধিতায়, শহিদের সংখ্যা বিতর্কে, স্বাধীনতার ঘোষণা বিতর্কে, পেট্রল বোমায় মানুষ হত্যায়, চাপাতি সংস্কৃতিতে ঐক্যবদ্ধ আছে একটি গোষ্ঠি নিজের নানা ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শিক পরিচয় সত্বেও। শুধু বিভক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ভেতর। আজ যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তারা আশা করি ভাববেন, নিরাপত্তাহীনতা ও আইনহীনতার ধারণা একবার জনমনে পাকাপোক্ত হয়ে বসলে তাহলে সুশাসনতো প্রশ্নই আসে না, সাধারণ শাসনই অসম্ভব হয়ে যাবে। ঐক্যের অন্তর্নিহিত শক্তি কারও অজানা নয়। আজ দেশের রাজনীতি, সমাজ, মানুষ- সবকিছুই ব্যাপকভাবে বিভাজিত। এ বিভাজনের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির বিভাজন সবচেয়ে বিপজ্জনক। বিভাজন কমানোর প্রথম ও প্রধান দায়িত্বটি এই সরকারকেই নিহতে হবে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে। এইচআর/এমএস
Advertisement