জাতীয়

‘কিছু পাওয়ার আশায় নয়, স্বৈরাচার পতনে আন্দোলনে গেছি’

এনামুল কাওসার। বয়স ৩০। বাবা মৃত আনিসুর রহমান। বাড়ি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ঘুরকা ইউনিয়নের মধ্যপাড়া। ডান পা হারানো কাওসার দুই মেয়ে, মা, একমাত্র ভাই ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার করছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার পতনের ঠিক একদিন আগে অর্থাৎ ৪ আগস্ট ডান পায়ের হাঁটুতে গুলি লাগে তার। পায়ে পচন ধরার কারণে গত ২৪ আগস্ট অর্থাৎ ২০ দিন পর তার পা কেটে ফেলা হয়।

Advertisement

কাটা পা নিয়ে কাওসার এখন রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) নিচতলায় ক্যাজুয়ালটি-২ ইউনিটের জি-৩৪ বেডে চিকিৎসাধীন।

সোমবার (২৬ আগস্ট) পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাজুয়ালটি-২ ইউনিটের ৫৬টি বেডের সব কটিতেই ছাত্র আন্দোলনে গুরুতর আহতরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হওয়ায় তাদের কারও পা কেটে ফেলা হয়েছে। কারও আবার পায়ে রড লাগানো হয়েছে। কারও গুলি লেগে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে হাড়।

এমনই ভয়াবহ পরিণতির শিকারদের একজন এনামুল কাওসার।

Advertisement

কিসে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলনে অংশ নিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এনামুল কাওসার বলেন, ‘’ ‘কোনো কিছু পাওয়ার আশায় আন্দোলনে অংশ নেইনি। দেশ থেকে স্বৈরাচার পতনের জন্য আন্দোলনে গেছি।’ বর্তমানে বিভিন্ন দাবি নিয়ে যারা মাঠে আন্দোলন করছে, তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ বলেও জানান কাওসার।

এদিন সরেজমিনে দেখা যায়, সদ্য পা হারানো কাওসার এখন পরিবারের চিন্তায় চিন্তিত, বিশেষ করে দুই মেয়ের জন্য। বড় মেয়ে সুন্নাতের বয়স তিন বছর, ছোট মেয়ে ছোঁয়ার বয়স এক বছর। বাবা হারানো কাওসারের বাসায় অসহায় হয়ে পড়ে আছেন বৃদ্ধা মা। এরই মধ্যে চিকিৎসা ও অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া বাবদ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

জানা গেছে, নিটোর হাসপাতালে পৌঁছানো সহজ ছিল না কাওসারের। কারণ ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর স্থানীয় হাসাপাতাল এমনকি বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল হাসপাতালের কোনো ডাক্তার কাওসারের চিকিৎসা করাতে চাননি। অভিযোগ রয়েছে, চাকরি হারানোর ভয়ে কাওসারের চিকিৎসা করাতে চাননি কেউ। ফলে অধিক রক্তক্ষরণ হয় কাওসারের। ১০ ব্যাগ রক্ত দিতে হয় তাকে।

আরও পড়ুন

Advertisement

পঙ্গু হাসপাতালে ছাত্রদের চিকিৎসায় অবহেলা, মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা ঢাকা মেডিকেলের অবস্থা দেখে রাফা ক্যাম্পের মতো মনে হয়: হাসনাত আহতদের ঢাকার ১৩ হাসপাতালে ভর্তির অনুরোধ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের

কাওসার জানান, সিরাজগঞ্জ এম মনসুর আলী হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়। সেসময় এই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তাপস পাল বলেন, আন্দোলনের রোগী দেখলে সমস্যা হবে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে অর্থাৎ ৫ আগস্ট সন্ধ্যার পর থেকে জিয়া মেডিকেরে তাকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর নিটোরে ভর্তি করা হয়। নিটোরে ভর্তি করার পর কয়েকটি অপারেশন করা হয়। তারপরও পায়ের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।

গুলিতে মূলত পায়ের হাটুর হাড় টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এমনকি স্পটেও হাটুর কিছু টুকরো পড়ে যায়। কয়েকটি অপারেশন করার পরও হাটুর গুলি লাগা অংশে পচন ধরা শুরু করে। এই পচন শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে যাওয়ার ভয়েই মূলত পা কেটে ফেলা হয় তার।

বাবাহারা কাওসারের পরিবার দেখভাল করেন একমাত্র চাচা আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাতিজা কোনো কিছু পাওয়ার আশায় আন্দোলনে যায়নি। আমরা এখন মন খুলে কথা বলতে পারি, প্রকৃত স্বাধীন দেশে বাস করছি, এটাই বড় পাওয়া। পরিবারে ছয়জন সদস্য। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল কাওসার।’

আনসার সদস্যদের আন্দোলন প্রসঙ্গে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছে তারা ধান্দাবাজ। তাদের তো চাকরি অর্ধেক আছে। আর আমার ছেলেটা আজ সব হারালো। আন্দোলন করলে আমরা করবো, তারা কেন করছে? তাদের তো আন্দোলনের সময় মাঠে দেখিনি।’

এনামুল কাওসারের ছোট ভাই নাজমুল ইসলাম বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন। তার পড়ালেখার খরচও বহন করতেন বড় ভাই কাওসার।

নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সবেমাত্র পড়ালেখা শেষ করলাম। বড় ভাই আমাদের একমাত্র অভিভাবক। আমিও আন্দোলনে ছিলাম। আমরা কিছু পাওয়ার আশায় আন্দোলনে যাইনি। কোনো কিছুর বিনিময়ে আমার ভাইয়ের পা পাবো না। তবে এটা সত্য আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি, কারণ একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল আমার বড় ভাই।’

এমওএস/ইএ/এমএস