মতামত

দোষারোপে কি থামবে বন্যার্তের হাহাকার?

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আগের তুলনায় বৃষ্টিপাত কমে এসেছে শনিবারের পর। আশা করা যায়, শিগগিরই এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে-কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী অঞ্চলে। এরমধ্যে কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার বুরবুরিয়ায় গোমতী নদীর পাড় ভেঙ্গে বাঁধের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।শুধু গোমতী নদীর রক্ষাবাঁধ ভাঙলেও হয়তো ক্ষতিটা হতো বুড়িচং এর ৫/৭ মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এরইমধ্যে সালদানদীর পাড়ও ভেঙ্গে গেছে। ফলে গোমতীর পানি ও সালদানদীর পানি এক হয়ে বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মানুষকে চরম দুর্ভোগে ফেলেছে। দুদিক থেকে ধেয়ে আসা বন্যার পানি এখনও বাড়ছে। যদিও উজানে ভারতীয় পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টি কমে যাওয়ার সুসংবাদ পাওয়া গেছে।

Advertisement

বাংলাদেশে এমন বন্যার মতো দুর্যোগ নতুন কিছু নয়। তবে দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যা হয় না বহুবছর ধরে। ওই এলাকায় যাদের বয়স ৩৫/৪০ বছর তারা অনেকেই বন্যার ভয়াবহতা দেখেনি। সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ বন্যা না দেখায় এবং অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বন্যা বিস্তার লাভ করায় এবারে আতঙ্কটা অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি ছিলো। আগের বন্যার সঙ্গে এবারের বন্যায় জনআতঙ্ক বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হচ্ছে মোবাইলের অবাধ ব্যবহার এবং আগাম সতর্কতার প্রয়োজনে মাইকিংও ভূমিকা রেখেছে। রাতভর মাইকিং করে মানুষকে সতর্ক করার উপকার যেমন আছে আতঙ্ক ছড়াতেও সক্ষম এটি।

বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে তিস্তার কারণে যেভাবে ওই এলাকার মানুষ প্রতিবারই বন্যার ভয়াবহতা দেখে, বন্যা মোকাবিলায় তাদের যে অভিজ্ঞতা পূর্বাঞ্চলের মানুষের সেটা নেই অধিকাংশেরই। নতুন করে হওয়া এই বন্যায় এই অঞ্চলের মানুষকে তাই হতবাক করে দেয়। দিশেহারা হয়ে যায় মানুষ।

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যার প্রধান কারণ ভারতীয় পাহাড়ি এলাকার অতিবৃষ্টি। এবারও তাই ঘটেছে। ভারতের আবহাওয়াবিষয়ক সরকারি সংস্থা আইএমডির ১৫ থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত রাজ্যভিত্তিক বৃষ্টিপাতের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময়ে ত্রিপুরায় গড়ে ৩১৪.৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৯৮ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত ভারতের আরেক রাজ্য মিজোরামে এ সময় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১১৭ শতাংশ এবং উত্তরে সীমান্তবর্তী রাজ্য মেঘালয়ে ৬৭ শতাংশ বেশি ছিল। উজানের এই বৃষ্টিতে ওখানকার মানুষকে চরম ভোগান্তিতে ফেললেও উঁচুভূমি হওয়ায় তাদের দুর্ভোগ কমতে সময় বেশি লাগছে না। কারণ পানি নিচে গড়িয়ে বাংলাদেশকে তলিয়ে দিতে শুরু করে। যা স্বাভাবিকও বটে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় জনপদ এর প্রভাবে তলিয়ে যেতে থাকে।

Advertisement

ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে বন্যার কারণ নিয়ে। সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ভারতকে দায়ি করেছেন বন্যা সৃষ্টির জন্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এই বিষয়ে। বলা হচ্ছে ,ত্রিপুরার গোমতী নদীতে গম্বু ‘বাঁধ’- এর গেইট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে এই ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে বিবিসি ২০ আগস্ট একটি সংবাদ পরিবেশন করে, বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া এবং ভারতীয় পক্ষের বক্তব্য্ উল্লেখ করে। সেখানে ত্রিপুরার বিদ্যুৎ মন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, ত্রিপুরা গম্বু ড্যাম-এর কোনো গেইটই তারা খুলে দেননি। বিদ্যুৎ ‘দফতরের মন্ত্রী রতন লাল নাথ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “যে প্রচারটা করা হচ্ছে ডম্বুর গেট খুলে দেওয়া নিয়ে, সেটা অপপ্রচার ছাড়া কিছু না।”

“গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনও গেট খুলে দেওয়া হয়নি। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জলাধারটির সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ৯৪ মিটার। জলস্তর এর বেশি উঠলেই নিজের থেকেই জল গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ...এর মধ্যে একটি গেট দিয়ে ৫০% হারে জল বেরোচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে আগে থেকেই মাইকিং করে সতর্ক থাকার অনুরোধও জানানো হয়েছিল,” বিবিসিকে বলছিলেন রতন লাল নাথ।’

সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও দুইভাবে সংবাদগুলো পরিবেশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, এই বন্যা সৃষ্টির জন্য ভারতই দায়ী। আবার ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, ভারত কোনো গেইট খুলে দেয়নি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাংলাদেশি ব্যবহারকারীরা প্রায় শতভাগই বলছেন, এটা ভারতের কারসাজি। তারা আগাম কোনো বার্তা প্রদান করেনি।’

কিন্তু বিখ্যাত নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত এই বিষয়ে বলেছেন ভিন্ন কথা। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ এর ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকাকে বলেছেন,‘ভারতে গোমতী নদীর উপর একটি ড্যাম রয়েছে এবং চট্টগ্রামের কাপ্তাইতেও একটি ড্যাম রয়েছে। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এ ড্যামগুলো পূর্ণ করা হয়, কারণ যত বেশি পানি সংরক্ষণ করা যাবে, তত বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। তবে বর্ষার শেষ দিকে যদি বৃষ্টি হয়, তখন ড্যামগুলো আর পানি ধরে রাখতে পারে না।

Advertisement

ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব ইতিবাচক নয়। এটা স্বীকার করতেই হবে। সেই কারণে মানুষ ক্ষোভ প্রকাশও করতে পারে। কিন্তু এই বন্যার সতর্কবার্তা বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ থেকে কেন প্রচার করা হলো না তা তলিয়ে দেখতে হবে। ভারত কেন জানায়নি এমন অভিযোগ করতে গিয়ে নিজের অবহেলা ঢাকলে এমন দুর্ভোগ আবারও হবে না তেমনটা বলা যায় না।

এই ড্যামগুলো জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্যা প্রতিরোধের জন্যও ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই ত্রিপুরা এবং কুমিল্লার নিম্নাঞ্চলে দীর্ঘদিন বন্যা হয়নি। যার কারণে দীর্ঘ ৩০ বছরে কুমিল্লায় কোনো বন্যা হয়নি।

দ্বিতীয়ত, গোমতী নদীর অববাহিকায় ড্যামটি অবস্থিত। এর অর্থ হলো এ ড্যামের কারণে ফেনী, নোয়াখালী কিংবা চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে বন্যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু গতকালের পত্রিকা থেকে আমি জেনেছি, এসব এলাকায় ও ত্রিপুরায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর এ অতি বৃষ্টির কারণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া একটি নিম্নচাপ। তবে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা।

...এসব তথ্য বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরও পেয়েছে। তারা তাদের রাডারের মাধ্যমে বৃষ্টির বিষয়টি জানতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। যদি একদিন আগেও আমাদের সতর্ক করা হতো, তাহলে আমরা নিজেদের প্রস্তুত করতে পারতাম।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলা হচ্ছে-গেইট খুলে দেওয়ার আগে ভারত বাংলাদেশকে সতর্কবার্তা প্রদান করেনি। ভারত বলছে, গেইটই যেখানে খোলা হয়নি বার্তা দেওয়া হবে কি? আর গম্বুতে কোনো বাঁধই নেই আছে ড্যাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের আবহাওয়া বিভাগের ব্যর্থতা কিংবা অদক্ষতা সম্পর্কে তেমন কিছু মন্তব্য হয়েছে আমার চোখে পড়েনি।

অত্যন্ত দুঃখজনক হচ্ছে, বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লাখ লাখ মানুষ বাঁচার জন্য লড়াই করছে। সেই জীবনসংগ্রামের মাঝখানে চলছে রাজনীতি। এই রাজনীতি কি বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পারবে? এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে বন্যার্তদের সহযোগিতা,তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং সাহস দেওয়া। তা না করে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করাটা কতটুকু শুভ তা ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করি।

নিবন্ধের উপরে উক্ত অংশ পড়ে এমন মনে করার কারণ নেই যে,পানি রাজনীতিতে ভারত বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেনি। ৫৪টি অভিন্ন নদীতে বাঁধ কিংবা ড্যাম নির্মাণ করে ভারত বাংলাদেশকে মরুভূমি হওয়ার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টিও এখানে উল্লেখ্য। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সম্মত হওয়ার পরও তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না,পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর বাধার মুখে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন ঠেলাঠেলির বিষয় আমরা আগেও দেখেছি।

ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিটমহল চুক্তি করেছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারতের পাওনা বুঝিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু ছিটমহল চুক্তির চূড়ান্ত বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় অর্ধশত বছর। বলা হচ্ছিল-ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত সেটা পার্লামেন্টে অনুমোদন হয়, কিন্তু তার জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে।

এদিকে গঙ্গা চুক্তি নবায়ণের সময় ঘনিয়ে আসছে। আগামী বছর নবায়ণ হওয়ার কথা। চলমান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গঙ্গা চুক্তি নবায়ণে কি প্রভাব ফেলবে তাও বলা যাচ্ছে না। গঙ্গাচুক্তি সম্পাদনকালে দুই দেশের সুসম্পর্ক ছিলো। হালে জনমত ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছে। এই অবস্থায় গঙ্গাচুক্তির ভবিষ্যৎ কি হতে পারে জানা নেই।

ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব ইতিবাচক নয়। এটা স্বীকার করতেই হবে। সেই কারণে মানুষ ক্ষোভ প্রকাশও করতে পারে। কিন্তু এই বন্যার সতর্কবার্তা বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ থেকে কেন প্রচার করা হলো না তা তলিয়ে দেখতে হবে। ভারত কেন জানায়নি এমন অভিযোগ করতে গিয়ে নিজের অবহেলা ঢাকলে এমন দুর্ভোগ আবারও হবে না তেমনটা বলা যায় না।

লেখক: সাংবাদিক,মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম