মতামত

রাজনৈতিক মামলার অভিশাপ থেকে মুক্তি চায় ছাত্র-জনতা

নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল বাংলাদেশের মানুষের ওপর। এমনকি এই শাসনে পর্যুদস্ত হয়েছিল অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীও। জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী নেতাকর্মী শুধু বঞ্চিতই হয়নি, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, আক্রমণ এমনকি হাত-পা কেটে দিয়েছে আওয়ামী লীগের নামে ক্ষমতা ভোগকারীরা।

Advertisement

দেশের অধিকাংশ জেলার সচেতন নাগরিকরা তা দেখেছেন। ১৫ বছরে তৈরি হয়েছিল একটি বেনিফিসিয়ারি এবং লুটেরা গোষ্ঠী, যারা পুরো দেশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিল। ক্যাপিটাল ফর্মেশনের সময় সব দেশেই কিছু অর্থনৈতিক অনিয়ম হয় বলে অর্থনীতিবিদরা বিশ্বাস করেন। কিন্তু আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরে যে অর্থনৈতিক লুটপাট হয়েছে তা পৃথিবীর সব উদাহরণ ছাড়িয়ে গেছে। এ বিষয় আর না বলি।

এই ১৫ বছরে শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতার ঔদ্ধত্যের কারণে শুধু ন্যায় অন্যায় বোধই হারিয়ে ফেলেনি, তারা বিগত দিনের অভিজ্ঞতাও পায়ে ঠেলে উপেক্ষা করেছে। যতগুলো কারণে বিএনপি-জামায়াত সরকারের পতন হয়েছিল, তার একটি ছিল ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা। স্মৃতিভ্রম হয়নি এমন সবার মনে আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু স্মৃতিভ্রম হয়েছিল আওয়ামী সরকারের লুটপাটকারীদের, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল। ঔদ্ধত্যের চোটে তারা মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাটের ওপর হামলা, পিটার হাসের ওপর হামলা চেষ্টা এসব উপেক্ষা-অবজ্ঞা করেছেন। শুধু তাই নয়, ড্যান মাজিনার মতো একজন রাষ্ট্রদূতকে ‘কাজের বিটি মর্জিনা’, রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ‘পাতি হাস’ বলে মশকরা করেছেন। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অপরাধ খুব কম আছে। কারণ কাণ্ডজ্ঞান হারানো মানুষ সব ধরনের অন্যায় অপরাধ করতে পারে। আওয়ামী লীগের বেনিফিসিয়ারিরা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত এই কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ক্ষমতার দাপটে যুক্তরাষ্ট্র কত বড়, কত ক্ষমতাশালী দেশ তাও এরা ভুলে গেছেন।

এই ১৫টি বছর ধরে ক্ষমতাসীনরা চারদিকে শত্রু বানিয়েছে, চারদিকে মানুষকে অসন্তুষ্ট করে তুলেছে। যে কারণে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিপ্লব হয়েছে। এখানে শুধু বিএনপি-জামায়াতের সমর্থন ছিল তা নয়, আপামর জনতার, এমনকি আওয়ামী লীগের বঞ্চিত অনেক মানুষও মাঠে নেমে এসেছিল। এই বিষয়টিই আওয়ামী লীগের নেতারা বুঝতে পারেননি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের নেতারা যে কোনো সমস্যা, যে কোনো অসন্তোষের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ভূত দেখতে পেতেন। অথচ তাদের ঘাড়েই চেপেছিল ভূত।

Advertisement

কিন্তু এখন যা ঘটছে তার মধ্য থেকে একটি পক্ষ রাজনৈতিক ফায়দা ও প্রতিশোধের খেলায় নেমেছে। একথা সত্য বিগত ১৫ বছরে অনেক বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামির নেতাকর্মী নির্যাতিত হয়েছেন, এমনকি আয়নাঘর নামক মধ্যযুগীয় নির্যাতন কামরায় কাটিয়েছেন। (প্রাসঙ্গিক বলে রাখা ভালো, আয়নাঘর পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। কিন্তু সেটা মূলত গোয়েন্দারা রাখে যারা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করে, বিদেশি চর হিসেবে কাজ করে তাদের জন্য। কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এ ধরনের গোপন স্থানে আটকে রাখার কোনো সুযোগ নেই। অথচ শেখ হাসিনা সরকার তাই করেছে)। আমরা সেই নির্যাতনের বিচার চাই। কিন্তু দেশব্যাপী এখন যা ঘটছে তা ওই নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যতটা, তারচেয়েও বেশি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ভবিষ্যতের পথ পরিষ্কার করার অপকৌশল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র নেতারাও কিন্তু এ ব্যাপারে পরিষ্কার বক্তব্য দিয়েছেন। মানুষ জীবন দিয়েছে কোনো একটি দলকে সমর্থন করে নয়, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি অশনিসংকেত। অনেক মানুষ কিন্তু সেকথা বলতে শুরু করেছে, সেটা কান পেতে শুনতে হবে। খুবই দুঃখের কথা হবে আন্দোলনকারী, আন্দোলনে শহীদ এবং তাদের পরিবার স্বজনদের জন্য, যদি আবার প্রতিহিংসার ঘূর্ণাবর্তে দেশ তলিয়ে যায়। সামনে আজ হোক বা কাল হোক নির্বাচন হলে যে বিএনপি অথবা জামায়াত ক্ষমতায় আসবে এটা অনেকটা পরিষ্কার। কিন্তু তারাও যদি প্রতিশোধের নির্বাচন করতে গিয়ে নিরীহ মানুষকেও হয়রানি করে, তাহলে একই পরিণতি যে তাদের জন্য ফিরে আসবে না এমন কোনো নিশ্চয়তা কি আছে? নাই। কিন্তু বিপদের কথা হলো, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ হাতে ক্ষমতা পেলে কাণ্ডজ্ঞান, বিচার-বিবেচনা বোধ হারিয়ে ফেলে।

এটা আমরা স্বাধীনতার পর থেকেই দেখে আসছি।

ভিক্টোরিয়া শোফিল্ড তার ‘ভুট্টো: ট্রায়াল অ্যান্ড এক্সিকিউশন’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘অনেক দেশের মতো পাকিস্তানেও একটি প্রবণতা হচ্ছে, একজন রাজনৈতিক নেতাকে পূজণীয় বানিয়ে ফেলা হয় এবং তার সব দোষত্রুটি ঢেকে দেওয়া হয়। ওই লোকটিই যখন ক্ষমতায় থাকে না, তখন তার সেই পূজনীয় ইমেজ মুছে দিতে সত্য তো প্রকাশ করা হয়ই, সঙ্গে অনেক জঘন্য মিথ্যাচারও জড়িয়ে দেওয়া হয়।’

ভুট্টোর বিচার প্রক্রিয়ার ঘটনাবলি কিছুটা বর্ণনা করলেই বোঝা যাবে এসব দেশে আমরা রাজনৈতিক মামলার কাছে কতটা অসহায় হয়ে আছি। ১৯৭৪ সালের ১০ নভেম্বর পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি মেম্বার আহমাদ রাজা কাসুরি লাহোরে একটি বিয়ে বাড়িতে যান দাওয়াত খেতে। সঙ্গে তার পিতা নওয়াব মোহাম্মদ খান এবং পরিবার। বিয়ে বাড়ি থেকে যখন বের হন তখন গাড়িচালকের আসনে রাজা কাসুরি এবং তার পিতা সামনের অন্য আসনটিতে। কাছেই ওত পেতে থাকা দুষ্কৃতকারীরা একের পর এক গুলি চালাতে থাকে, কাসুরি গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। গাড়ির লাইট-জানালার কাচ সব ভেঙে যায়। তিনি লক্ষ্য করেন তার পিতা তার ঘাড়ের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ, ওই হমলায় কাসুরির ৭২ বছর বয়সের পিতা নিহত হন। কে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে তা নিয়ে কাসুরি বিভিন্নজনকে সন্দেহ করতে থাকেন, এমনকি ভুট্টোকেও। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং মিসেস ভুট্টো যখন তাকে ফোন করে শোক জানান, তখন কাসুরি সন্তুষ্ট হন এবং ভুট্টোকে সন্দেহ করার জন্য ক্ষমা চান। এর পূর্বে কাসুরি পাকিস্তান পিপলস পার্টির সদস্য ছিলেন। এবার তিনি আবার পিপিপিতে যোগদান করেন। এবং পিপিপি থেকে মনোনয়ন চান। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হন। এরমধ্যে রাজনৈতিক ওলটপালট হয়ে যায়।

Advertisement

১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই জেনারেল জিয়াউল হক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ভুট্টোকে অপসারণ করেন। এই জিয়াউল হককে ছয়জন সিনিয়র ডিঙিয়ে সেনাপ্রধান করেছিলেন ভুট্টো। যাই হোক, জিয়াউল হক ক্ষমতায় আসার পরই ওই হত্যা মামলায় ভুট্টোকে প্রধান আসামি করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের ফেডারেল সিকিউরিটি ফোর্সের মহাপরিচালক মাসুদ মাহমুদ স্বীকারোক্তি দেন যে ওই হত্যার পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন ভুট্টোর নির্দেশে। গোলাম হুসেন নামে একজন ফেডারেল সিকিউরিটি ফোর্সের ইন্সপেক্টরও একই রকম স্বীকারোক্তি দেন। তারা দুজনই হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং অচিরেই তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়! প্রধান আসামি হন ভুট্টো। ওই সময় লাহোর হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি করা হয় মৌলভী মুশতাককে। এই মৌলভী মুশতাকের সঙ্গে ভুট্টোর বিরোধ ছিল ১৯৬৩ সাল থেকে। ভুট্টো তখন ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মুশতাক ছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে মৌলিক অধিকারের ওপর একটি বিল নিয়ে দুজনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৯৬৮ সালের আইউব খান যখন ভুট্টোকে কারাগারে পাঠান তখন সেই ট্রায়ারের বিচারক ছিলেন মৌলভী মুশতাক। ভুট্টো ভয়ানক ক্ষিপ্ত ছিলেন মুশতাকের প্রতি। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মুশতাকের সিনিয়রিটি বারবার ভঙ্গ করে অনেক জুনিয়রকে তার ওপরে পদায়ন করেছিলেন। এসব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীরও চোখ এড়ায়নি।

এই ঘটনা কিন্তু আমাদের জন্য খুবই শিক্ষণীয়। যদি না শিখি তাহলে আওয়ামী সরকারের মতোই কাকে কখন খেসারত দিতে হবে তা বলা যায় না। যদি সত্যিই সভ্য হতে চাই, তাহলে মামলারও একটি মিনিমাম মেরিট থাকতে হবে। সাকিব আল হাসানের অ্যারোগ্যান্ট হিসেবে একটা বদনাম আছে। তার কিছু অর্থনৈতিক অনিয়ম, আয়কর ফাঁকির কথাও শোনা যায়। কিন্তু দেশের কে না বোঝে যে সাকিব আল হাসান রুবেলের হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না! ৫ আগস্ট রুবেল যখন নিহত হন তখন সাকিব কানাডায় একটি ক্রিকেট ম্যাচ খেলছেন। একটা মামলায় দেখলাম র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বিরুদ্ধে আরজিতে বলা হয়েছে, তিনি আঙুল তুলে হত্যা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। অথচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিছু লোকের মতে, এটা অসম্ভব। তিনি তখন ঢাকায় ছিলেন। তাছাড়া তিনি যাই করুন, এতটা বোকা নন, যে ওইভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে রেকর্ড করে রাখবেন। এরকম দেশব্যাপী আরো অনেক ঘটনা ঘটছে, যা মানুষের কাছে শেষ বিচারে গ্রহণযোগ্য হবে না।

ভয়ানক একটি অশনিসংকেত দিয়ে শেষ করি। দীপু মনির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। বহুকাল ধরে জেনে আসছি দীপু মনির ভাইয়ের ঘুস বাণিজ্যের কথা, দীপু মনিদের ভূমি নিয়ে জোরজবরদস্তির কথা। দীপু মনি ছিলেন ক্ষমতার একেবারে কাছাকাছি। তার ক্রিয়াকলাপে ভয়ানক অসন্তুষ্ট ছিলেন বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। তারা তাকে রাস্তায় পেয়ে পিটিয়ে মেরে ফেললেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। তার ক্রিয়াকর্মের জন্য দীপু মনির আজীবন জেল হলেও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু দীপু মনিকে আদালতে হাজির করার সময়ে যে দৃশ্য দেখেছি, তাতে শুধু অবাক হইনি, হতাশ হয়েছি এবং আশা ভঙ্গ ঘটেছে। যে আইজীবীরা বিচার নিশ্চিত করবেন, সুবিচার চাইবেন, তারা পুলিশের বেড়াজাল ভেঙে দীপু মনিকে গায়ে হাত তুলেছেন! আবার দেখলাম একজনের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে পার্থক্য কী রইল? এই জিঘাংসার মধ্য দিয়ে কি ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী সমাজ চাওয়া পূরণ হতে পারে! বিষয়টি কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার নজরেও পড়েছে। ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ভাষণে তিনি বলেন, জোর করে প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তি বিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেফতারদের আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার প্রবণতা অগ্রণযোগ্য।

লেখক: সাহিত্যক ও সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস/ফারুক