সাহিত্য

কালসন্ধ্যা: কৃষ্ণের মহাপ্রয়াণ

নান্টু রায়

Advertisement

মহারণের পর ঊনচল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কুরুক্ষেত্রে ভারতের ক্ষত্রিয়কুলের প্রায় সকলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত। অবশিষ্ট ছিল যাদবগণ, এরা কৃষ্ণের স্বজন। কিন্তু এরা নিতান্ত কুক্রিয়াসক্ত ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। এরা এতদূর পর্যন্ত পানাসক্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, কৃষ্ণ-বলরাম ঘোষণা করেছিলেন যে, দ্বারকায় যে মদ তৈরি করবে, তাকে শূলে চড়ানো হবে। বৃষ্ণি, ভোজ, অন্ধক প্রভৃতি বিভিন্ন বংশজাত যাদবেরা পরস্পরের প্রতি ঘোরতর বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়ে উঠলেন। তাঁরা সমস্ত ধর্ম ত্যাগ করলেন। কৃষ্ণের শতাধিক বছর বয়স হয়েছে। এদের সংযত করা তাঁর সাধ্য নয়। কৃষ্ণ যাদবদের ‘বিনাশ বাসনা’য় তাদের প্রভাসতীর্থে যাত্রা করতে বললেন।

দ্বারকার আকাশে রাহুগ্রস্ত হলো সূর্য, যেমন হয়েছিল হস্তিনাপুরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে। কুরুক্ষেত্রকে উপলক্ষ করেই যদুকুলের মধ্যে হননস্পৃহা প্রজ্জ্বলিত হলো। মদ চলছে পাত্রের পর পাত্র। প্রভাসতীর্থ মারাত্মক প্রমোদে মুখর—যাদবেরা আকণ্ঠ ডুবে গেছে মদিরায়। হঠাৎ সাত্যকি তীক্ষ্মস্বরে বলে উঠলেন, ‘হার্দিক্য, তুমি ছাড়া এমন নিষ্ঠুর আর কে আছে যে নিদ্রিতকে বধ করতে পারে?’ সেই কুখ্যাত নৈশ অভিযান, কৌরবপক্ষের শেষ দারুণ প্রতিহিংসা—তাঁর নিন্দা শুনে সরোষে উত্তর দিলেন কৃতবর্মা, ‘শৈনেয়! মনে নেই তুমি ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবার শিরোচ্ছেদ করেছিলে? তুমি নৃশংস নও?’ তিক্ত, আরও তিক্ত হয়ে উঠল কলহ, আরও অনেক পুরোনো ক্ষোভ উন্মথিত হলো নতুন করে, সাত্যকি খড়্গের আঘাতে কৃতবর্মাকে ভূরিশ্রবার পথে পাঠিয়ে দিলেন। ছড়িয়ে পড়ল জন থেকে জনে অসংবরণীয় জিঘাংসা, ভোজ ও অন্ধকদের হাতে প্রাণ হারালেন সাত্যকি ও প্রদ্যুম্ন। বেদনার সঙ্গে আমাদের মনে পড়ে রৈবতক উৎসবের সেই দৃশ্যটি, যেখানে এই ভোজ, অন্ধক, বৃষ্ণিরা প্রায় একইভাবে তাঁদের নারী ও সুরাপাত্র নিয়ে গোষ্ঠীসুখে মেতেছিলেন এবং যেখানে অর্জুন-সুভদ্রার বিবাহের এবং পাণ্ডব-যাদবের সেই মৈত্রীর সূত্রপাত হয়েছিল, যার ফলে যুদ্ধে জয়লাভ করলেন পাণ্ডবেরা, আজ তার শেষ হলো—উৎসন্ন হলো যদুবংশ। যুদ্ধাবশিষ্ট দশজনের মধ্যে পাণ্ডবপক্ষে পাণ্ডবেরা পাঁচভাই, সাত্যকি আর কৃষ্ণ এবং কৌরবপক্ষে কৃতবর্মা—কী দুর্ভাগ্য এঁদের, এঁরা ক্ষত্রোচিত-গরীয়ানভাবে প্রাণ দিতে পারলেন না; যুদ্ধের হাজার বিপদ থেকে বাঁচিয়ে মৃত্যু এঁদের হাতে রেখে দিয়েছিল এমন এক অবসান, যা বিলাপবেদনার ন্যূনতম উচ্চারণের যোগ্য নয়।

মহাযুদ্ধের অন্তিম দিনে, শল্যের মৃত্যুর পরে কুরুক্ষেত্রেও নেমে এসেছিল মত্ততা। আর ছিল না কোনো সামরিক শৃঙ্খলা বা প্রকল্প, ছিল না কোনো সুচিন্তিত আক্রমণ ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা। যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল এক নির্বোধ ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড—কে আত্মপক্ষ আর কে-ই বা পরপক্ষ তাও বোধগম্য হয়নি; যোদ্ধারা রক্তের গন্ধে মাতাল হয়ে হাতের কাছে পাওয়ামাত্র বধ করেছেন শত্রুকে এবং মিত্রকেও। তার চেয়েও ব্যাপক ও ভীষণ মত্ততা যদুবংশকে আচ্ছন্ন করে দিলো—শুধু কোনো কীর্তিমান অভিজাত-গৃহের অবক্ষয় নয়, কোনো একটি মহৎ বংশের বিলুপ্তিও নয় শুধু—একটি সম্পূর্ণ সভ্যতার ধ্বংস, মানুষিক বুদ্ধি ও চেতনার সার্বিক ও প্রতিকারহীন নির্বাপণ। প্রথমে নামল এক ভ্রান্তি, যাতে সুসংস্কৃত অন্নের মধ্যে দৃষ্ট হয় গণনাতীত কীট, অনুভূত হয় সুখশয়ান সুপ্তির মধ্যে মুষিকদংশন, ছাগ ডাকলে শৃগালের চিৎকার শ্রুত হয়—আর তারপর ওইসব দুর্লক্ষণ পেছনে ফেলে, কিন্তু অনতিক্রম্য কালের বশীভূত হয়ে যাদবেরা চলে এলেন সেই সমুদ্রের তীরে, যার জলে শাম্ব-প্রসূত প্রথম মুষলটি চূর্ণ করে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। প্রচুর মদ ও মাংস, নারী ও ভোগসামগ্রী—এসব নিয়ে পূর্বদৃষ্ট দুঃস্বপ্নগুলোকে ভুলে থাকার মরিয়া চেষ্টায়, এক উৎকট উল্লাসে তাঁরা গা ভাসিয়ে দিলেন। স্ত্রী ও পুরুষ লিপ্ত হলো নির্লজ্জ যৌন ব্যভিচারে, মদ্য শুধু পান করা হলো না, বানরদের মধ্যে বিলানো হলো; যেন যমুনাতীরবর্তী অন্য এক অতীত প্রমোদের অনুকরণে ঘটনাস্থল ধ্বনিত হতে লাগল সুরাবিহ্বল নৃত্যে-গীতে-বিতণ্ডায়—সবই কৃষ্ণের সামনে। এতক্ষণ নিষ্ক্রিয় ছিলেন তিনি, অবিচল ও তুষ্ণিভূত এক দর্শকমাত্র, কিন্তু সাত্যকি ও প্রদ্যুম্নের মৃত্যুর পর তিনি প্রতিশ্রুত ও পূর্বজ্ঞাত সংহারক্রিয়ায় মেতে উঠলেন। এখন তিনি রথারূঢ় নন, তাঁর হাতে নেই গদা বা কশা বা সুদর্শনচক্র, তাঁর চিত্ত এখন বীতরাগ ও বীতমন্যু—পুনরাবৃত্ত তরঙ্গের মত প্রাণোচ্ছ্বাস তিনি পেরিয়ে এসেছেন। আর তাই, মনে মনে ‘কালপর্যায়’ বুঝে নিয়ে হাতের মৃদুতম ভঙ্গিতে তুলে নিলেন সেই ঈশিকা তৃণ (শর বা কাশ), পাণ্ডবদের ধ্বংসের জন্য সৌপ্তিকপর্বে অশ্বত্থামা যা নিক্ষেপ করেছিলেন। সে-যাত্রায় পাণ্ডুপুত্রদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন কৃষ্ণ, কিন্তু তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠীকে তিনি দয়া করলেন না। তাঁর হাতে প্রতিটি তৃণ অপ্রতিরোধ্য মুষল হয়ে উঠল। তাঁর দেখাদেখি অন্যরাও হাতে তুলে নিল তৃণ—কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শ্মশানভূমিতে পরিণত হলো রঙ্গভূমি। পিতা পুত্রের, পুত্র পিতার মস্তকচূর্ণনে নিযুক্ত—এখানে করুণার কোনো অবকাশ পর্যন্ত নেই। একজন ছিলেন বভ্রু, এই উন্মত্ততা যাঁকে স্পর্শ করেনি। যাদব বভ্রু কৃষ্ণকে বললেন, ‘জনার্দন! আপনি অনেক লোকের প্রাণ সংহার করেছেন। এখন চলুন আমরা মহাত্মা বলভদ্রের কাছে যাই।’ কুলধ্বংস হবার পর বভ্রুও এক আকস্মিক মুষলের আঘাতে নিহত হলেন—যেমন হয়েছিলেন, ঘোষিত যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরে, অতর্কিতে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ও ধৃষ্টদ্যুম্ন। শুধু রইলেন প্রধানতম দুই বার্ষ্ণেয় পুরুষ—কিন্তু তাঁরাও আর বেশিক্ষণ থাকবেন না।

Advertisement

তিনি চেয়েছিলেন যদুবংশের ধ্বংস এবং তা সচেতনভাবে সাধন করেছিলেন। গান্ধারী ও নারদ-কণ্বের অভিশাপ তো প্রতীকী। তিনি আবার ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করলেন—অদ্ভুতভাবে রূপান্তরিত এক ঈশ্বর, যিনি দিব্যবসনে মাল্যে কিরীটে অলংকৃত নন, নন সহস্র সূর্যের চেয়েও দীপ্তিশালী তেজঃপুঞ্জ, সহস্র চোখ-মুখ-বাহুবিশিষ্ট জগৎব্যাপী সত্তা আর নন—কিন্তু এক ভূষণরিক্ত জীবনক্লান্ত পুরুষ, যিনি তাঁর ঈশ্বরত্বের লক্ষণস্বরূপ গ্রহণ করেছেন প্রকট মরত্ব—যথাসময়ে, স্বেচ্ছায়। এখনো তিনি লোকক্ষয়কারী, কিন্তু তার কালাগ্নিসদৃশ রূপ এখন নির্বাপিত, তাঁর সংহারকর্মেও তিনি অনুগ্র ও উদাসীন। যেন নিজের সঙ্গে গোপন একটা চুক্তি ছিল তাঁর, কৌরব-পাণ্ডবদের উপলক্ষ করে এতদিন ধরে তা-ই তিনি পূরণ করলেন; তাঁর সেই কর্মপরায়ণ মানুষিক ভূমিকার এবার অবসান ঘটল। যুদ্ধকালে অর্জুনকে যেমন বলেছিলেন, ‘ত্রিলোকে আমার কোনও কর্তব্য নেই, তবু আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি। যদি আমি কর্ম না করি তাহলে লোকেরা কর্মত্যাগ করবে।... লোকসংগ্রহের জন্য—সৃষ্টিরক্ষার জন্যই—কর্ম করণীয়’, এখনো কৃষ্ণ জানেন যে, বিরতিরও প্রয়োজন ঘটে মাঝে-মাঝে, মাঝে-মাঝে সন্ধিক্ষণ আসে যখন কালের ঘূর্ণনও মুহূর্তের জন্য থেমে যায় যেন—যখন সমস্ত যুদ্ধ সমাপ্ত, সব উদ্যম নিঃশেষ, পৃথিবীর বীরবংশ লুপ্ত অথবা লুপ্তপ্রায়, কোথাও নেই কোনো সংকট বা সংঘর্ষ এবং নেই কোনো সূচনারও ইঙ্গিত। এমন সময় আসে, যখন ‘সংগ্রহ’ ও সংহার সমার্থক হয়ে ওঠে, পূর্ণ হয় কোনো বৃত্ত, বিশ্বসংসারে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষার জন্যই প্রয়োজন হয় ধ্বংসের। আর সে-রকম সময়ে বুঝি ঈশ্বরও অপসৃত হন—অন্তত ইতিহাস থেকে, প্রপঞ্চময় সংসার থেকে। যে-বিশাল প্রয়াসের জালে কৃষ্ণ স্বেচ্ছায় বন্দী হয়েছিলেন এবং সমগ্র ক্ষত্রকুলকে বন্দী করেছিলেন, সেটি অনেক আগে থেকেই আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনছিলেন তিনি, এবার তাঁকেও ফিরে যেতে হবে, তিনি প্রস্তুত।

তিনি প্রয়োগ করেছিলেন সাংখ্য যোগ বেদান্ত থেকে সম্ভবপর প্রতিটি যুক্তি, নিখিলজ্ঞানের ওপর তাঁর কর্মবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, দেখিয়েছিলেন অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ; —কত কল্পনার দ্যুতি, কত চিত্রকল্পের ঐশ্বর্য, জীবন-মৃত্যুর কত রহস্যের কত উদ্ঘাটন; আর তবু, যেন অর্জুনের মন থেকে শেষ সংশয়বিন্দুটি বিমোচনের জন্য তিনি ঘোষণা করেছিলেন সেই মাভৈ-বাণী—অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যঃ মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ। ‘ধর্মক্ষেত্র’ কুরুক্ষেত্রে তিনি পাপের পর পাপে লিপ্ত করেছিলেন অর্জুন, ভীম, যুধিষ্ঠিরকে কিন্তু নিজে ছিলেন অব্যাকুল ও অব্যথিত, আদ্যন্ত একইভাবে ক্ষমতাপন্ন ও ক্ষমতার ব্যবহারকারী; যে ভীষ্ম তাঁর প্রধানতম বন্দনাকারী, তাঁর জন্য কোনো বেদনা তিনি প্রকাশ করেননি; যে-কর্ণের সঙ্গে একবার তিনি মর্ম-কথা বিনিময় করেছিলেন—বন্ধুর মতো, প্রীতিস্নিগ্ধভাবে, সেই কর্ণের হত্যায় তিনি ছিলেন অনুকম্পাহীন। আর এখন এই ভয়াবহ ঘটনাপর্যায়ে—মনে হয় তাঁর প্রতিটি আবেগবিন্দু নিষ্কাশিত হয়ে গেছে, অনাচারমত্ত যাদবদের প্রতি তাঁর ক্রোধের উদ্রেক পর্যন্ত হলো না, ওষ্ঠ থেকে নিঃসৃত হলো না কোনো তিরস্কার—যেন নিষ্পলক চোখে চেয়ে দেখলেন সব, মুখের একটি পেশী কুঞ্চিত না করে—যেন গাছ থেকে খসে-পড়া শুকনো পাতার চেয়েও তাঁর আত্মীয়-ভ্রাতা-পুত্রের জীবন মূল্যহীন। এই-ই তাঁর প্রক্ষালন ও প্রতিদান, এই হলো তাঁর প্রায়শ্চিত্ত—তাঁর স্বকৃত এবং কুরুবংশের সব পাপের জন্য—যুধিষ্ঠিরের ধরনে নয়, বিলাপের উচ্ছ্বাসে নয় (কেননা তিনি শোক ও মনস্তাপের অতীত)—এক প্রত্যক্ষ ও চরম উপায়ে, স্বহস্তে তাঁর স্ববংশকে সংহার করে। এখন তাঁর একটিমাত্র কৃত্য অবশিষ্ট আছে—কিন্তু সেটা আসলে তাঁর কোনো কর্ম নয়, সেটা কর্মের নিরসন, ঘটনা থেকে প্রস্থান।

সারথি দারুককে কৃষ্ণ হস্তিনায় অর্জুনের কাছে পাঠালেন। অর্জুন এসে যাদব কুলকামিনীদের হস্তিনায় নিয়ে যাবেন, কৃষ্ণ এমন আজ্ঞা করলেন। বিপর্যস্ত ক্লান্তক্লিষ্ট যদুপতি পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, ‘যতক্ষণ অর্জুন এসে না পৌঁছান, আপনি এখানে পুরস্ত্রীদের রক্ষা করুন; বলরাম বনের মধ্যে আমার প্রতীক্ষায় আছেন, আমি তাঁর কাছে যাই। বহু কুরুবীরের নিধনকাণ্ড আমি দেখেছি, আজ যদুকুলের বিনষ্টিও দেখলাম। এখন আমি বলরামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তপস্যা করব।’

বলরাম বেজায় মদ্যপান করেছিলেন। সেই অবস্থায় যোগাসনে বসলেন। ধীরে ধীরে তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হলো। তাঁর প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তাঁর মুখ থেকে সহস্রফণা এক বিশাল সর্প নিঃসৃত হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সমুদ্রে। বিষ্ণুপুরাণে কবি এমন চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। হয়তো তাঁর মুখ থেকে মদের ধারা নানামুখে নির্গত হচ্ছিল। তা দেখে কৃষ্ণও মর্ত্যলোক ছাড়ার বাসনায় মহাযোগ অবলম্বন করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। অপ্রহার্য অপতনীয় পুরুষ কৃষ্ণ—স্বাস্থ্য শক্তি যৌবনের এক অফুরন্ত উৎস: তিনি প্রাণত্যাগ করলেন বনের মধ্যে ভূমিশয়নে জরা নামে এক ব্যাধের নিক্ষিপ্ত একটিমাত্র বাণের আঘাতে— তাও কোনো মর্মস্থলে নয়, পদতলে! বিষ্ণুপুরাণে কৃষ্ণপ্রয়াণের এমন কথা বলা হয়েছে।

Advertisement

কৃষ্ণপ্রয়াণের এই আশ্চর্য ঘটনায় যেন সম্পূর্ণ হলো মহাভারতে তাঁর অলোকসামান্য ভূমিকা। ভগবদ্গীতায় যত উঁচুতে তিনি উঠেছিলেন, এবারে ঠিক তত নিচেই তাঁর অবতরণ ঘটল। এই মৃত্যু—মানবেতিহাসের হীনতম এই মৃত্যু—এও তাঁর ঈশ্বরত্বেরই একটি ব্যঞ্জনা; ভীষ্মের বা বলরামের মতো কোনো মহিমান্বিত অবসান অশোভন হতো তাঁর পক্ষে, এমনকি ঠিক রুচিসম্মত হতো না; এমন একটি লৌকিক অথবা জান্তব মৃত্যুর ফলে তিনি আমাদের হৃদয়ের কাছে বিশ্বাস্য ও বাস্তব দেবতা হয়ে উঠলেন: যিনি ‘লোকসংগ্রহে’র জন্য কর্ম করে থাকেন, তিনিই ‘লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল’—গীতায় উক্ত এই সূত্রটি আমাদের সামনে দর্শনীয় হলো। ছায়াছবির মতো মিলিয়ে গেল তাঁর যদুবংশ, ঈশ্বরের অন্তর্ধান ঘটল।

অর্জুন দ্বারকায় এসে বসুদেবের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি ছিলেন তাঁর বার্ধক্যের বিশ্রাম-লালসা নিয়ে অন্তঃপুরে। সমুদ্রতীরে তার পুত্রগণ পরস্পরকে হত্যা করছে, বলরামের সর্পরূপী প্রাণ বহির্গত হলো, কৃষ্ণ অরণ্যে মৃত্যুশয়ন পেতেছেন; তাঁর শ্রেষ্ঠ পুত্রদ্বয় যে মৃত, তাও বসুদেব জেনেছিলেন কি না সন্দেহ। অর্জুনের আগমন পর্যন্ত কষ্টে-সৃষ্টে বেঁচে থাকার মতো প্রাণশক্তি শুধু অবশিষ্ট ছিল তাঁর। অর্জুনকে শুধু বললেন, ‘তিনি (কৃষ্ণ) আমাকে বালকদের সঙ্গে এখানে রেখে যে কোথায় গেলেন তা-ও জানি না।’ অর্জুনের অপেক্ষাতেই যেন তিনি প্রাণধারণ করে ছিলেন।

কৃষ্ণ-বলরামের পারলৌকিক কর্ম সম্পাদন করে অর্জুন যাদব কুলকামিনীদের নিয়ে হস্তিনায় রওনা হলেন। পথিমধ্যে একদল দস্যু লগুড় হাতে তাঁদের আক্রমণ করল। অর্জুনের চোখের সামনেই যাদবরমণীদের হরণ করে নিলো দস্যুরা—মহাবীর তাঁর দিব্যাস্ত্রসমূহের ব্যবহার বিস্মৃত হলেন। তিনি গাণ্ডীবে শরযোজনা করতে পারলেন না, তাঁর অক্ষয় তূণ নিঃশেষিত হলো। যে-পীতবসন দ্যুতিমান পুরুষ তাঁর রথের আগে ছুটে-ছুটে শত্রুসৈন্যকে দগ্ধ করতেন, তিনি আর তাঁকে দেখতে পেলেন না; যে কৃষ্ণ সবই বিনষ্ট করতেন, সেই কৃষ্ণের অদর্শনে তিনি এখন অবসন্ন। তাঁর সবদিক শূন্য হয়ে গেল। তাঁর হৃদয়ের শান্তি অন্তর্হিত হলো। অনেক কুলনারী স্বেচ্ছায় দস্যুদের হাতে আত্মদান করল। বেলাতিক্রান্ত সমুদ্র গ্রাস করে নিলো দ্বারকাপুরীকে। পরাস্ত ও বিধ্বস্ত অর্জুন নতশিরে এসে দাঁড়ালেন ব্যাসদেবের সামনে। বিষ্ণুপুরাণে এমন বর্ণনা আছে, কিন্তু মহাভারতে তেমন কিছু পাই না।

সূত্র: বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাট্য ‘কালসন্ধ্যা’ অবলম্বনে।

এসইউ/জেআইএম