ফুটবলে চরম দুঃসময়। বৃহস্পতিবার শেষ হওয়া দলবদলে অংশ নেয়নি শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র। দল করতে চায়নি চট্টগ্রাম আবাহনীও।
Advertisement
শেষ পর্যন্ত জাতীয় দলের সাবেক দুই ফুটবলার জাহিদ হাসান এমিলি ও মামুনুল ইসলাম দায়িত্ব নিয়ে এই ক্লাবে ৩৬ জন ফুটবলারকে নিবন্ধন করিয়েছেন। ফুটবলাররা কোনো প্রকার চুক্তি ও অগ্রিম ছাড়াই খেলার স্বার্থে সই করেছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর ফরমে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে প্রিমিয়ার লিগ থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে সাবেক দুই চ্যাম্পিয়ন শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র। দুটি ক্লাবেরই পৃষ্ঠপোষক ছিল বসুন্ধরা গ্রুপ।
তারা ক্লাব থেকে সরে গেলে তৈরি হয় সংকট। দুটি ক্লাব দল না করার ঘোষণা দিলে হতাশা তৈরি হয় খেলোয়াড়দের মধ্যে। প্রিমিয়ার লিগের সর্বাধিক ৬ বারের চ্যাম্পিয়ন আবাহনীরও খেলা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত আবাহনী দল গঠন করলেও খেলোয়াড়দের দেওয়া হচ্ছে না চুক্তি অনুযায়ী টাকা। বিভিন্ন সূত্র বলছে, আবাহনী যে পরিশ্রমিকে খেলোয়াড়দের নিবন্ধন করিয়েছে তা হতাশাজনক।
Advertisement
আবাহনী এবার বিদেশি খেলোয়াড়ও নেয়নি। বিদেশি খেলোয়াড় নেয়নি চট্টগ্রাম আবাহনী ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবও। বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে অনেকবার ঝড়ঝাপ্টা এসেছে। তবে এমন হতাশাজনক অবস্থা কখনো দেখা যায়নি।
ফুটবলারদের চরম দুর্দিনে কোনো সংগঠক এগিয়ে না আসলেও এসেছেন দুই ফুটবলার। জাহিদ হাসান এমিলি চার বছর আগে সাবেক হয়েছেন, মামুনুল ইসলাম এখনো খেলছেন। ওই দুইজন হাল ধরেছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর। তারাই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া চট্টগ্রাম আবাহনীকে মাঠে রাখার উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
দেশের ফুটবলের চরম এই দুঃসময় ফুটবলারদের পাশে দাঁড়ানো দুই ফুটবলারের একজন জাহিদ হাসান এমিলি একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জাগো নিউজকে।
জাগো নিউজ: ফুটবলের দলবদলের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রায় এক’শ ফুটবলারের কান্না আপনার হৃদয় ভেঙেছে। শেষ পর্যন্ত আপনার ও মামুনুল ইসলামের নজিরবিহীন উদ্যোগে ৩৬ জন ফুটবলার খেলার ব্যবস্থা হয়েছে। বিষয়টিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
Advertisement
এমিলি: আগেই জানা ছিল শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র এ বছর দল তৈরি করছে না। পরে এমনও খবর পেলাম অনিশ্চিত চট্টগ্রাম আবাহনীর দলগঠনও। এমন কি আবাহনীর খেলোয়াড়রাও অনিশ্চিত সময় কাটাচ্ছেন। আমাদের ফুটবলারদের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গুপ আছে। সেই গ্রুপে ফুটবলারদের হতাশা প্রকাশের ভাষা সইতে পারিনি। চলে গিয়েছিলাম বাফুফে ভবনে। তারপর আমি আর মামুনুল আলোচনা করে চট্টগ্রাম আবাহনীতে ৩৬ ফুটবলারের রেজিস্ট্রেশন করি।
জাগো নিউজ: আপনাদের দুইজনের কেউই চট্টগ্রাম আবাহনীর কোনো দায়িত্বে নেই। তো আপনারা কীভাবে দল গঠন করলেন?
এমিলি: আপনি জানেন যে, দলবদলের শেষ সময় ছিল ২২ আগস্ট রাত ১২ টা। আমরা রাত ১০ টার দিকে সিদ্ধান্ত নেই ওদের রেজিস্ট্রেশন করিয়ে রাখা যায় কিনা। পরে যা হবে, পরে দেখা যাবে। মামুনুল চট্টগ্রাম আবাহনীর মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি চায়। তারা অনুমতি দিয়ে ক্লাব থেকে রেজিস্ট্রেশন ফরম আনা হয়। তারপর খেলোয়াড়দের স্বাক্ষর নিয়ে বাফুফেতে জমা দেওয়া হয়।
জাগো নিউজ: যারা দলে নাম লেখালো তাদের পারিশ্রমিক কীভাবে ঠিক করলেন, ক্লাবটি খেলায় অংশ নেবেই কীভাবে? তাতে তো অনেক টাকার দরকার। এই টাকা আসবে কোত্থেকে?
এমিলি: ওই সময় এতকিছু ভাবার সুযোগ ছিল না। আমাদের প্রথম কাজ ছিল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খেলোয়াড়দের নিবন্ধন করা। না হলে ওরা যে একটি বছর খেলতে পারবে না, সবার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। তাই কোনো পারিশ্রমিক, কোনো অগ্রিম কিছুর দিকেই তাকায়নি খেলোয়াড়রা, আমাদের কথায় ফরমে সই করে দিয়েছে। এখন আমাদের ফান্ডের কথা ভাবতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনারা তো পাহাড়সম বোঝা মাথায় নিয়েছেন। শুধু দল করলেই তো হবে না, এই দলের থাকাখাওয়া, অনুশীলন, জার্সি, বুট, ভেন্যুতে যাওয়া-আসা ও স্টাফদের বেতনসহ অনেক টাকার বিষয়। যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ক্লাবটির দায়িত্ব নিয়েছেন, সেটা সামলাবেন কী করে?
এমিলি: খেলোয়াড়রা যদি একটি টাকাও না নেন, তাহলেও কোটি টাকা লাগবে। ওদের কিছু সম্মানি দিলে তো পরিমাণ আরো বাড়বে। আমরা আপাতত অর্ধকোটি টাকার কিছু বেশি একটা বাজেট করেছি। আমার আর মামুনুলের পক্ষে তো এ টাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব না। আমরা একটা ফান্ড তৈরির চেষ্টা করছি। কেউ কেউ আশ্বাসও দিয়েছেন। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
জাগো নিউজ: ক্লাব মানেই একটা প্রতিষ্ঠান। সেখানে আপনারা মুখে মুখে দায়িত্ব নিয়ে কীভাবে চালাবেন?
এমিলি: আমরা হুটহাট কথা বলে খেলোয়াড়দের স্বার্থে দল করার দায়িত্ব নিয়েছি। এখন ক্লাব থেকে আমাদের একটা লিখিত অনুমতি লাগবে। না হলে পরে সমস্যা হবে। কারণ, ক্লাব একজনের, দল আরেকজন করলে সেই অথরিটি কে হবেন? আমরা এসব নিয়ে কাজ করবো।
জাগো নিউজ: ফুটবলের যে অবস্থা তৈরি হলো, এর জন্য কি পরিস্থিতি নাকি সিস্টেমকে দায়ী করবেন?
এমিলি: আসলে সিস্টেম তো একদিনে তৈরি হয় না। বছরের পর বছর ঘুরে এই সিস্টেম হয়েছে। ফুটবলের এ অবস্থার জন্য পরিস্থিতিই দায়ী।
জাগো নিউজ: আপনারা সংগঠক হিসেবে নাম লেখাননি। মামুনুল তো এখনো খেলেন। কিন্তু যারা বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে ফুটবল থেকে সুবিধা নিয়েছেন, তাদের কেউ কি ফুটবলারদের এই দুর্দিনে উদ্যোগ নিতে পারতেন না?
এমিলি: ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই পারতেন। আমি আর মামুনুল তো কোনো রাজনীতি করি না। আমরা শুধু ফুটবলারদের স্বার্থটাই দেখেছি। একটি বছর ওরা খেলতে পারবে না, সেই চিন্তা করেই এই ঝুঁকি নিয়েছি। আমরা দলমত নির্বিশেষ শুধু ফুটবলারদের কথাই ভেবেছি। যারা দীর্ঘদিন ফুটবলের সুবিধা নিয়েছেন, ক্লাবের পরিচয় দিয়ে সমাজে চলেছেন তারা ফুটবলারদের এই দুর্দিনে তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এটা দুঃখজনক।
জাগো নিউজ: যে দুইটি ক্লাব নাম প্রত্যাহার করলো, তাদের বিষয়ে তো সরকারে পক্ষ থেকে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। তারপরও কেউ এগিয়ে না আসার কারণ কী মনে করেন?
এমিলি: সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার বলা হলো শেখ জামাল ও শেখ রাসেলের নামে ক্লাব চালাতে সমস্যা নেই। এরপরও কেউ এগিয়ে আসলেন না। একটা ক্লাবের সবাই তো রাজনীতি করেন না। যারা রাজনীতি করেন তাদের সমস্যা তৈরি হলেও বাকিরা তো এগিয়ে আসতে পারতেন। সবাই তো পালিয়ে যাননি। সরকার থেকে যখন বলা হলো ক্লাবের নাম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই তখন তো সেই দলের হাল ধরাটা কারো জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। আসলে ইচ্ছা থাকলেই কেউ না কেউ এগিয়ে আসতে পারতেন। এগিয়ে আসা উচিত ছিল। কেউ এগিয়ে আসেননি সেটাই এই দেশের ফুটবলের দুর্ভাগ্য।
জাগো নিউজ: ফুটবলাররা যখন চরম দুর্দিনে তখন একদল সংগঠক ব্যস্ত বাফুতে ঢোকার জন্য। আপনারা দুইজন ফুটবলারদের জন্য যা করলেন কোনো সংগঠককে তো সেই উদ্যোগ নিতে দেখলাম না। কেন?
এমিলি: আসলে ফুটবলে সবাই আসেন নিজেদের স্বার্থে। ফুটবলারই যদি না থাকেন, খেলাই যদি না থাকে তাহলে বাফুফেতে গিয়েই লাভ কী? ফুটবলারদের এই দুঃসময়ে কোনো সংগঠককে একটা বিবৃতিও দিতে দেখলাম না। কেউ না কেউ খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। আমরা কোনো জায়গা থেকে কোনো উদ্যোগও দেখলাম না।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কী করার ছিল? দেশের অভিভাবক সংস্থাটির কোনো উদ্যোগ দেখেছেন কি?
এমিলি: আসলে বাফুফে থেকে যাদের উদ্যোগ নেওয়ার কথা, তারা নিজেরাই তো অফিসে আসেন না। সবাই সেভ জোনে চলে গেছেন। খেলোয়াড়দের জন্য তাদের কিছু করার ছিল। তাদের বোঝা উচিত খেলোয়াড় ও খেলা না থাকলে বাফুফে থাকার কোনো মানেই হয় না।
জাগো নিউজ: আপনারা তো বাফুফে সভাপতির সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। তার উদ্যোগ কি যথেষ্ট ছিল বলে মনে করেন?
এমিলি: আমরা কয়েকবার সভাপতির কাছে গিয়েছিলাম। যেসব ক্লাব খেলবে না তাদের কয়েকজনকে আমাদের সামনেই ফোন করেছিলেন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন। অনুরোধ করেছেন, তিনি তো জোর করতে পারেন না।
জাগো নিউজ: আমরা জেনেছি ৯০ থেকে ৯৫ লাখ টাকা চুক্তির খেলোয়াড়কে এখন ৫ লাখ টাকায় খেলতে হবে। এটা তো ফুটবলের জন্য চরম দুঃসংবাদ। এমন দিন ফুটবলে দেখবেন ভেবেছিলেন?
এমিলি : আপনি ঠিকই জেনেছেন। ৫০ থেকে ৯৫ লাখ টাকায় চুক্তি করা ফুটবলারদের এখন গড়পরতা ৫ লাখ টাকায় খেলতে হচ্ছে। ৭০-৮০ জন ফুটবলার তো খেলতেই পারছেন না দুটি ক্লাব দল না গড়ায়। ফুটবলারদের চরম দুঃসময়। ফুটবলে এমন দুর্দিন দেখবো কখনো ভাবিনি। আমরা যারা ফুটবল খেলেছি, এখন যারা খেলছেন কেউই এমন খারাপ সময়ের কথা কল্পনাও করতে পারেননি।
জাগো নিউজ: জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া দল পাননি। কোনো ক্লাবে দেখা যাবে না মতিন মিয়া, মাসুক মিয়া জনি ও রেজাউল রেজাদেরকেও। এটা তো ভাবনারও বাইরে ছিল, তাই না?
এমিলি: একটি দেশের অধিনায়ক কোনো দলে নেই। এই একটি ঘটনাই দেশের ফুটবলের চরম দুর্দিনের উদাহরণ। বিশ্বের কোথাও দেখবেন না যে, জাতীয় দলের অধিনায়ক কোনো ক্লাবে নেই।
জাগো নিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
এমিলি: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরআই/এমএমআর/এএসএম