জাতীয়

চট্টগ্রামে রেকর্ড বৃষ্টি, পানিবন্দি আড়াই লাখ মানুষ

চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত। ব্যাপক বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে শহরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও রাস্তাঘাট। একই সঙ্গে জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন জেলার পাঁচটি উপজেলার অন্তত আড়াই লাখ মানুষ।

Advertisement

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দুপুর ১২টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে চট্টগ্রামে শুক্রবারও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।’

এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ভারী বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে নগরের কাপ্তাই রাস্তার মাথা, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, মেহেদীবাগ, চকবাজার, বাকলিয়া ডিসি রোড, তিন পোলের মাথা, হালিশহরসহ নগরের বেশকিছু এলাকা ডুবে গেছে। টানা বৃষ্টি ও হালদা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, রাউজান ও হাটহাজারীতে অন্তত আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

তবে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার মো. ফাহমুন নবী জানান, তাদের হিসাবে সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম জেলার ৩টি উপজেলা (সীতাকুণ্ড, মীরসরাই এবং ফটিকছড়ি) দুর্যোগকবলিত। এতে ২০ হাজার ১৭৫ পরিবারের প্রায় ৯৫ হাজার ৯০০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

Advertisement

এর মধ্যে ফটিকছড়ি উপজেলায় সর্বমোট ১৩টি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ায় ৩ হাজার ১৭৫ পরিবার পানিবন্দি এবং প্রায় ১৫ হাজার ৯০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত; মীরসরাই উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নে ১২ হাজার পানিবন্দি পরিবারের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত এবং সীতাকুণ্ড উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নের ৫ হাজার পরিবারের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। তবে স্থানীয় সূত্র বন্যার ব্যাপকতা আরও বেশি বলে দাবি করেছে।

ফটিকছড়ি

বুধবার রাতেই উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ধুরং ও হালদা নদীতে পানির চাপ বাড়ায় অন্তত ৬টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। উপজেলার বেশিরভাগ গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে রয়েছে। ঘরবাড়িতে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ফসলি জমির। বন্যার কারণে ফটিকছড়ি থেকে হেঁয়াকো রামগড় সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানিতে ডুবে রয়েছে উপজেলার মাইজভান্ডার-রাউজান সড়কও।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজ্জামেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ফটিকছড়ি দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদী ও বেশকিছু খালের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। লাখো মানুষ পানিবন্দি।’

আরও পড়ুনলক্ষ্মীপুরে ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দিআমরা বাঁধের মুখ খুলিনি, একা একা খুলে গেছে: ভারতনোয়াখালী-কুমিল্লা-ফেনীতে ভারী বৃষ্টি থাকতে পারে আরও ৪৮ ঘণ্টা

‘আমরা ১৮টি ইউনিয়নের জন্য ১৮ জন কর্মকর্তা নিয়োগ করেছি। তারা সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর আমাদের জানাচ্ছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি মনিটর করছে। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় লোকজনকে আশ্রয় দিতে আমরা ৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছি।’ বলেন মোজ্জামেল হক চৌধুরী।

Advertisement

রাউজান

হালদার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তলিয়ে গেছে রাউজানের পশ্চিম নোয়াপাড়া, মোকামীপাড়া, সাম মাহালদারপাড়া, ছামিদর কোয়াং, কচুখাইন, দক্ষিণ নোয়াপাড়া, উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম, সওদাগরপাড়া, সুজারপাড়া, পূর্ব উরকিরচর, খলিফার ঘোনা ও বৈইজ্জাখালি, বাগোয়ান, পশ্চিম গুজরা, গহিরা, নোয়াজিশপুর, চিকদাইর, ডাবুয়া। এসব গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

নোয়াপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার অনেকটা ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছেন। এলাকার কয়েকশ একর চাষাবাদের জমি ৫ থেকে ৬ ফুট পানি নিচে ডুবে গেছে। পানির তোড়ে ভেঙে পড়েছে বিদ্যুতের কয়েকটি খুঁটি। এতে বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আশপাশের গ্রাম।’

মিরসরাই

চট্টগ্রামেরর মিরসরাইয়ে টানা বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে ৬০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে করে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এখানকার সাধারণ মানুষদের। এছাড়াও মুহুরী প্রজেক্ট এলাকার মৎস্য ঘেরের বাঁধ ভেঙে কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্য চাষিরা।

স্থানীয় সূত্র বলছে, গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার সীমন্তবর্তী এলাকা আমলীঘাট, করেরহাট, হিঙ্গুলী, বারইয়ারহাট পৌরসভা, মিরসরাই পৌরসভার নিম্নাঞ্চল, জোরারগঞ্জ, ইছাখালী, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিঠানালা, খৈয়াছড়া, ওসমানপুর, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা পরিষদের প্রশাসক মাহফুজা জেরিন বলেন, ‘মিরসরাইয়ে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।’

সীতাকুণ্ড

উজান থেকে নামে আসা পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভেঙে গেছে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন বেড়িবাঁধের একটি অংশ।

উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকায় শিকদার খালের মুখে বাঁধের প্রায় ১২ মিটার অংশ ভেঙে যাওয়ায় জোয়ারের সময় পানি ঢুকছে লোকালয়ে। বন্যার পাশাপাশি ভারী বৃষ্টি আরও ঝুঁকি তৈরি করছে।

হাটহাজারী

বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চর, শিকারপুর, গড়দোয়ারা, দক্ষিণ মাদার্শা, উত্তর মাদার্শা, মেখল, পৌরসভার একাধিক ওয়ার্ড, নাঙ্গলমোড়া, ছিপাতলী। হালদা নদীতে পাহাড়ি ঢল বাড়ায় নদী উপচে পড়ে তীরবর্তী এলাকার বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেছে।

হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, ‘বন্যার কারণে উপজেলার ৭ থেকে ৮টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি রয়েছেন প্রায় অর্ধলাখ মানুষ।’

সহকারী কমিশনার মো. ফাহমুন নবী বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় জেলা প্রশাসন ৫০ মেট্রিক টন চাল ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করেছে। বন্যা মোকাবিলায় এরই মধ্যে ২৩২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং গঠিত ১২৭টি মেডিকেল টিমের সব কয়টি চালু আছে।’

এদিকে চট্টগ্রামসহ ফেনী ও কুমিল্লায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচলরত আন্তঃনগরসহ সব ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

এএজেড/ইএ/জেআইএম