টানা ভারী বর্ষণে লক্ষ্মীপুরের সর্বত্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বসতবাড়ি, মাঠ-রাস্তাঘাট, বীজতলা ও ফসলের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে আছে। একইসঙ্গে মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারে উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। তবে জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে খাল দখল ও উপকূল প্লাবিতের ঘটনায় নদী তীররক্ষা বাঁধ না থাকাকে দুষছেন স্থানীয়রা।
Advertisement
বুধবার (২১ আগস্ট) বিকেলে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ রোড, সমসেরাবাদ, লামচরীসহ কমলনগর উপজেলার চরমার্টিন, চরলরেন্স ও চরকালকিনির নাসিরগঞ্জ এলাকায় গিয়ে পানিবন্দি বাসিন্দাদের দুর্দশার চিত্র দেখা যায়। এদিন সকাল থেকে পুরো জেলায় হালকা থেকে মাঝারি আকারের বৃষ্টি অব্যাহত থাকে।
গত ৪ দিনে লক্ষ্মীপুরে ৩১২.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন রামগতি উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সোহরাব হোসেন।
সরেজমিনে কমলনগরের নাসিরগঞ্জ এলাকায় পানিবন্দি একটি বাড়িতে ঢুকে ৫টি ঘর দেখা যায়। উঠানে জোয়ারের পানি থৈ থৈ করছে। আর ঘরের ভেতরে অন্ধকার। এতে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গৃহবধূ ও দুই কিশোরীকে টুপি বুনতে দেখা যায়। পানিবন্দি অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে ক্যামেরার সামনে কথা না বললেও দুঃখ-কষ্টের কথা অনর্গল বলতে থাকেন তারা।
Advertisement
এছাড়া রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে। এর থেকে বাঁচতে দ্রুত সময়ের মধ্যে নদীর তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা।
এদিকে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। লক্ষ্মীপুর কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয় ও লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ মাঠ পানির নিচে ডুবে আছে। কলেজ মাঠে স্থানীয় বাসিন্দাদের মঙ্গলবার রাতে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। এ এলাকার মানুষের বাসা-বাড়িতেও পানি ঢুকেছে বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বৃষ্টি কমলেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ফের বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।
নাসিরগঞ্জ এলাকায় পানিবন্দি বশির উল্লাহ, নিজাম উদ্দিন হাওলাদার, ইয়াছমিন বেগম, মোস্তফা মিয়া, আমির জান, ফারুক হোসেন ও লোকমান হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, পানিবন্দি হয়ে অনেকে রান্না করতে পারেননি। দুপুরে শুকনো খাবার খেতে হয়েছে অধিকাংশ পরিবারকে। আবার অনেককে দেখা গেছে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন দু’বার নদীতে জোয়ার আসে। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি নদী থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত লোকালয়ে প্রবেশ করে। নদীর কাছাকাছি এলাকার পানি ভাটায় নেমে যায়। কিন্তু নদী থেকে দূরবর্তী এলাকার পানি নামে না। জোয়ার চলে গেলেও জলাবদ্ধতা সেসব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে রয়ে যায়।
Advertisement
বশির উল্যা নামে এক বৃদ্ধ বলেন, বিগত সরকার ৩১শ কোটি টাকা ব্যয়ে নদী তীররক্ষা বাঁধের বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এমপি ও উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের জোরালো কোনো পদক্ষেপ ছিল না। বেড়িবাঁধ না থাকার কারণেই লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়। পানির তোড়ে গ্রামীণ রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, জোয়ারের পানি উঠে উপকূল প্লাবিত হয়। এছাড়া প্রচণ্ড বৃষ্টিতে চরপোড়াগাছা, রামগতি, আলেকজান্ডারসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। জোয়ার শেষে পানি নেমে যায়। কিন্তু খালগুলো বেদখলের কারণে জমে থাকা পানি নামছে না। এতে জলাবদ্ধতা তীব্র সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
কমলনগরের চরলরেন্স এলাকার বাসিন্দা সানা উল্লাহ সানু বলেন, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলাকে বন্যা থেকে বাঁচাতে পারে ভুলুয়া নদী। এ নদীটির অধিকাংশ এলাকা প্রভাবশালীদের কাছে বেদখল হয়ে আছে। সেনাবাহিনী ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় নদীটি দখলমুক্ত করলে এই দুই জেলার বাসিন্দারা উপকৃত হবে।
রামগতি প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের আবহওয়া পর্যবেক্ষক সোহরাব হোসেন বলেন, ১৭ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরে ৩১২.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। নদীতে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত ছিল। এখন তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) থেকে আবহাওয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, নদীভাঙন নিয়ে আপাতত কোনো অভিযোগ পাওয়া যাবে না আশা করছি। জিও ব্যাগ ডাম্পিং প্রায় শেষ। ১০২টি প্যাকেজের মধ্যে ৯২টি প্যাকেজের কাজ চলমান রয়েছে। খুব শিগগিরই বাঁধ নির্মাণ ও ব্লক স্থাপন করা হবে। নভেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে উপকূলে পানি ঢুকে পড়ে। বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হলেই এর সুফল পাবে উপকূলীয় বাসিন্দারা।
কাজল কায়েস/এফএ/জিকেএস