আইন-আদালত

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। ১৪ বছর পর নৃশংস সেই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় বিচারিক আদালতে রায় হয়। এখন মামলাটি হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি চলছে।

Advertisement

হাইকোর্টের বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) ডেথ রেফারেন্সসহ আসামিদের আপিল শুনানির জন্য রয়েছে।

এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি সুপ্রিম কোর্টের অবকাশের দুই সপ্তাহ পরে আবারও অনুষ্ঠিত হবে বলে ঠিক করেছেন আদালত। বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন আসামিপক্ষের ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান।

এনিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটির পর এ মামলার শুনানির সময় দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান আগের বেঞ্চ থাকলে সেখানে শুনানি হবে। আর যদি ওই বেঞ্চের জুরিসডিকশন না থাকে তবে নতুন বেঞ্চে শুনানি হবে। তবে যদি নতুন বেঞ্চ হয় তবে আবারও শুরু থেকে শুনানি হতে পারে বলেও জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

Advertisement

অন্যদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পুনরায় তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ন্যায় বিচারের স্বার্থে এ ঘটনায় জড়িত প্রকৃত আসামিদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি।

মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, যারা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা কিন্তু শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চায়নি। তারা চেয়েছিল, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে। বিএনপি সরকার যেন ক্ষমতায় না থাকতে পারে। এই পরিস্থিতি তৈরি করায় পরবর্তীতে এক-এগারো সরকার আসলো।

তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে সাবেক সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দিন আহমদ জড়িত থাকতে পারেন। মূলত এক-এগারো সৃষ্টি করার জন্যই ২১ আগস্টের ঘটনা ঘটেছে। যা দুঃখজনক ও ন্যাক্কারজনক।

মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, এ মামলায় নজিরবিহীনভাবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের আসামি করা হয়। আসামি মুফতি হান্নান প্রথমে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে অন্যদের নাম বলেছে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ মামলায় ৬৬ সাক্ষী হওয়ার পর বিএনপির আমলে বরখাস্ত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দকে পুনঃনিয়োগ দেয় সরকার। এ সময় তাকে এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

Advertisement

তিনি বলেন, এই কর্মকর্তা প্রতিহিংসাবশত মুফতি হান্নানকে ফের রিমান্ডে নিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করেন। দ্বিতীয়বার জবানবন্দিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এ মামলায় জড়ানো হয়।

গত বছরের ২১ আগস্টের আগে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মুহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন বলেছিলেন, ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে অগ্রাধিকারভিত্তিতে পেপারবুক (এজাহার, অভিযোগপত্র ও বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করা হয়। পেপারবুক পড়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পেপারবুক থেকে প্রায় ৩০ হাজার পাতা পড়া শেষ হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় আপিলটির শুনানি চলছে।

কোনো মামলায় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) মামলা হিসেবে পরিচিত। এ অনুসারে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য বিচারিক আদালতের রায় ও নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের জেল আপিল, আপিল ও বিবিধ আবেদনের ওপর সাধারণত এক সঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক প্রস্তুত করতে হয়।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে দলের নেতাকর্মীসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ কয়েকশ নেতাকর্মী।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) নতুন করে তদন্ত শুরু করে, বেরিয়ে আসে নতুন তথ্য। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালে হরকাতুল জিহাদের (হুজি) অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা।

পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এরপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মোট আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২।

২০১৮ সালে মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। একই বছর রায়সহ মামলা দুটির নথিপত্র হাইকোর্টে আসে, যা সংশ্লিষ্ট শাখায় ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। এরপর অগ্রাধিকারভিত্তিতে মামলা দুটির পেপারবুক ছাপানো হয়। এর মধ্যে কারাগারে থাকা ও জামিনে থাকা দণ্ডিত আসামিরা দুই মামলায় জেল আপিল ও নিয়মিত আপিল করেন।

রায়ের বিরুদ্ধে ৪৪টি জেল আপিল ও ৩৫টি নিয়মিত আপিল করেছেন দণ্ডিতরা। আসামিদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২৬ জন কারাগারে। ১৮ জন পলাতক। ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রধান বিচারপতি ডেথ রেফারেন্স মামলা দুটি শুনানির জন্য হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন। রাষ্ট্রপক্ষ পেপারবুক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর শুনানি শুরু করে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো:

বিচারিক আদালত ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। তারা হলো সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গিনেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাঈদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ বাট ওরফে মাজেদ বাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন হুজির নেতাকর্মী। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম ও হুজির সাবেক আমির শেখ আবদুস সালাম ২০২১ সালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

যাবজ্জীবন দণ্ডিত যাারা:

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন, আরিফুল ইসলাম, জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।

মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৬ জন পলাতক। তবে হারিছ চৌধুরী ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন বলে গত বছরের জানুয়ারিতে তার মেয়ে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সামিরা চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানান। তবে সরকার এখন পর্যন্ত এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেনি।

বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত যারা:

বিচারিক আদালত বিভিন্ন মেয়াদে ১১ জনকে দণ্ড দিয়েছেন। তারা হলো মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী; সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সিআইডির সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমীন এবং সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ ও মুন্সী আতিকুর রহমান।

অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয় ৩ জনের:

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মোট আসামি ৫২ জন। তাদের মধ্যে হুজির নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি কার্যকর হয় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায়। আরেক আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। বাকি ৪৯ জনের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালত রায় দেন। তাদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজনের সাজা শেষ হয়ে গেছে। এখন ভুক্তভোগীদের দৃষ্টি মূলত ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির দিকে।

এফএইচ/এসএনআর/এমএস