মতামত

স্থানীয় সরকার বাতিল: হয়ে যাক সংস্কার

চালই না বিকালে চাল কুমড়া নিয়ে দরাদরি একদম নিরর্থক -অবান্তর। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারই বাতিল, সংসদ বিলুপ্ত, সেখানে স্থানীয় সরকারগুলোকে ‘নাই’ করে দেয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। কলমের এক খোঁচাতেই এটি যথেষ্ট। এরপরও স্থানীয় সরকার বাতিলে কিছুটা সময় নিয়েছে অন্তবর্তী সরকার। ঢাকার দুই সিটিসহ দেশের ১২ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ৩২৩টি পৌর মেয়র, ৬০ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ৪৯৩ উপজেলা চেয়ারম্যান, সাথে ৯৮৮ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানকেও অপসারণ করে দেয়া হয়েছে।

Advertisement

স্থানীয় সরকারের আইন ও বিধিবিধান মতেই করা হয়েছে এই বাতিল ও অপসারনের কাজটি। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেছেন, এটি স্থানীয় সরকার সংস্কারের অংশ। মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ স্থানীয় প্রতিনিধিদের সেই প্রস্তুতি আগেই ছিল। নিজস্ব আমলনামা ও বেশিরভাগই বিগত সরকারের নেতা বা হোমড়া হওয়ায় তারা আগেই চম্পট দিয়েছেন। তারা এক এক জন কতো ’ভালো মানুষ’ , কী তাদের জনভিত্তি, আর কিসব কাণ্ডকীর্তি, তা নিজেরা জানেন বলে কার আগে কে দৗড়ে পালাতে ফার্স্ট হবেন, সেই প্রতিযোগিতা ছিল।

এরপরও বাতিল করতে একটু দেরি হওয়ায় কেউ কেউ কিঞ্চিত আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। ভেবেছিলেন স্থানীয় পর্যায়ের কিছু জরুরি কাজের প্রশ্নে তাদেরকে বোধ হয় রেখে দেয়া হতেও পারে। অথবা বিগত সরকারি দলের খাস লোকগুলোকে বাদ দিয়ে ভালো-নিরাপদ বা কম দুষ্টু বিবেচনায় কিছু লোককে রেখে দেয়ার একটি উড়ো খবর ঘুরছিল। কিন্তু, না কুল্লে খালাস। সোমবার প্রজ্ঞাপনে একদম সাফা। যথারীতি প্রশাসক নিয়োগ। এর বিরুদ্ধে আপত্তি বা টুঁ শব্দ করার সাধ্য্ও কারো হয়নি।

নামে স্থানীয় হলেও স্থানীয় সরকারের এই নেতা বা প্রতিনিধিদের কর্মক্ষেত্র বিশাল। স্থানীয় উন্নয়নের প্রতিনিধি তো তারাই। কাজের প্রশ্নে তারা মাননীয় না হলেও সম্বোধনে জনাব, মহাত্মন, হুজুরসহ অনেক কিছু। নির্বাচনের আগে দেয়া হলফনামায় দেখানো তাদের কারো কারো যতসামান্য আয়-রোজগার, সম্পদ-সম্পত্তির বিবরণীতে তা স্পষ্ট। আর তা তো তারা দেখানোর জন্যই দেখিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন দেখার কাজ দেখেছে। জানতে চায়নি কিভাবে কোন সোর্সে জমি-জিরাতসহ তাদের এতো সম্পদ? স্ত্রী-পুত্র কন্যারাই বা কিভাবে এতো বিত্তবান? বাস্তবটা ওপেন সিক্রেট। কম টাকার লোকদের জন্য কেবল জাতীয় সংসদ নয়, মেয়র, চেয়ারম্যান নির্বাচন করাও অসাধ্য। টাকাওয়ালা-ক্ষমতাবান ছাড়া প্রার্থী হওয়া বোকামি। সেই দৃষ্টে স্থানীয় নির্বাচনের প্রতিনিধিরাও এক এক জন বিশাল টাকাওয়ালা-বিত্তবান-হিম্মতবান। আর দলের খাস লোক তো বটেই। গোটা ব্যবস্থাটা সে রকমই করে ফেলা হয়েছে। কোথাও কোথাও তারা মন্ত্রি-এমপিদের অর্থের জোগানদার। কেউ-কেউ তো মন্ত্রী-এমপিদের জন্য থ্রেটও। যখন-তখন দেখিয়ে দেয়ার মুরদ রাখেন।

Advertisement

এই মুরদবানরাও হাল বাস্তবতায় এখন দৌড়ের ওপর। পদ গেছে, জানটাও যেন না যায় বা জেলে বাকি জীবন না কাটে সেই সাধনায় তারা। অথচ সংবিধানে, স্থানীয় সরকারের বিধিবিধানে তারা কতোইনা সম্মানের। চোরের মতো দৌড় দেয়ার মতো নন। বাস্তবে তাদের অভিভাবক এমপি-মন্ত্রীদেরই যেখানে লুঙ্গি ড্যান্সে পালাতে হয়, সেখানে তাদের বোরকা বা হাফপ্যান্ট পরে পালানোই নিয়তি।

স্থানীয় সরকার বলতে কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সেই এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসনকে বুঝায় যা কেন্দ্রীয় সরকারেরই একটি সমপ্রসারিত অংশ ৷ পদের আগে জাতীয় থাকলেও সংসদ সদস্যরাও নির্দিষ্ট এলাকা থেকেই নির্বাচিত। তাদের থাকার কথা সংসদে আইন প্রনয়ণে, আইন সংস্কারে বা জাতীয় বিষয়াদি নিয়ে। বাস্তবে এরঅকার গম-টিন, ইট-বালু সিমেন্ট-কাবিখা, দরিদ্র ভাতা, বিধবা ভাতা ধরনের কাজে চোখ বেশি। অথচ কাজগুলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।

সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রামের সাথে সংযুক্ত অন্যান্য সংস্থার কার্যকলাপে সম্পৃক্তা তাদের কাজ। কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা স্থানের সাধারণ মানুষের কল্যাণে থাকা তাদের কর্মক্ষেত্র। কেবল উন্নয়ন নয়, গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক। বাংলাদেশের সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দিতেই গঠন করা হয়েছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ৷ যার দ্বারা তৃণমূল পর্যায়ের উন্নয়নসহ সকল কর্মকান্ড পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ হবে ৷ কিন্তু, বাস্তবটা বড় করুণ। জনাব চেয়ারম্যান-মেম্বার, মেয়র-কাউন্সিলরদের এসব কাজে ভাগ বসানোতে মাননীয় এমপি-মন্ত্রীদের গরজ বেশি।

ক্ষমতা ও ভাগাভাগির অবসানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা জনগণের কাঙ্খিত লক্ষ্য। গণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকারের দাবি সবসময়ই পরস্পরকে গতিময় করেছে। গণতান্ত্রিক ধারনার উপর ভিত্তি করে একটি স্থানীয় সংস্থার প্রতিনিধি জনগণের স্বার্থকে তুলে ধরতে পারে। নির্বাচিত প্রশাসনের সাথে প্রতিটি স্তরের প্রশাসনে স্থানীয় সরকার সংস্থার সংযোগ স্থাপন করা অপরিহার্য। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০ এ একটি স্থানীয় সরকারের আউটলাইন রয়েছে যা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা বর্ণনা করে যাতে প্রশাসন প্রতিটি ইউনিটের জন্য জনগণকে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করাতে পারে। সাংবিধানিক প্রয়োজনের অনুপাতে এবং সব অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করার জন্য কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ইতিহাস দেখায় যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সময়সীমার মধ্যে গ্রাম, থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে স্থানীয় সংস্থা গঠনের জন্য আইন / অধ্যাদেশ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের কার্য ও দায়িত্বের মধ্যে প্রায়ই পরিবর্তন ঘটায়। ধারাবাহিক এই পরিবর্তনে গোটা ব্যবস্থাটা ছারখার করে ফেলা হয়েছে। একদিকে, দল-মার্কা মিলিয়ে স্থানীয়রাও জাতীয় হয়ে গেছেন। আবার এক একজন জাতীয় সদস্যরা যেমন একেকটা আসনের জমিদার, স্থানীয়রা হয়ে গেছেন তল্লাটের অধিপতি। কাগজকলমের ঠিকঠিকানা না থাকায় বহুদিন ধরে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা সামনে আসে মাঝেমধ্যেই। আসে সংস্কারের কথাও। এখ বলা হচ্ছে, সংস্কারের উদ্দেশ্যেই স্থানীয় সরকার বাতিল করা হয়েছে।

Advertisement

হলফ করে বলা যায়, যথাযথ সংস্কারে রাজনৈতিক কোনো দলই রাজি হবে না। যদি এমনটি করা হয় যে, এমপিরা কেবল আইন প্রণেতা হবেন। কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কর্ণধার হতে পারবেন না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হবে চার স্তরের স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে। আমলারা থাকবেন সেগুলোর সাচিবিক দায়িত্বে। আর সেগুলোর উপদেশক হবেন এলাকার সৎ ও যোগ্য লোকেরা। রাজি হবেন রাজনৈতিক দলের বড় নেতারা। মানে মন্ত্রী-এমপি হওয়ার রেসে থাকারা? আমলারাও? তারা রাজি হোন বা না হোন, অন্তবর্তী সরকার যদি ঠিকঠাকভাবে কাজটি করে অন্তত এই সময়টায় বাধা দিতে পারবে না। এরইমধ্যে কথা উঠেছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মাঠে না থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে কাজ হচ্ছে না। মাঠে থাকলে যে তারা কী সব করেন, তা সবারই জানা। দেশে তো এখন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও নেই। তারা কেউ পলাতক-ফেরারি। কেউ দেশছাড়া। সরকার কি চলছে না? অন্তর্বর্তী সরকার, তার পারিষদ, প্রশাসন কি কোনো কাজের খমতি রাখছে। তারপরও স্থানীয় সরকারের ক্রিয়াকর্মের দিকে একটু বেশি নজর দেয়ার বিষয় রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এই নজরদারি আরো ভালোভাবে পারবে। কোনো আতিপাতি বাধা দেয়া বা ভাগ বসাতে সাহসই পাবে না। এ সুযোগে শুরু হোক না সংস্কারটা।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

এইচআর/এএসএম