জুলাই ১৭, ২০২৪ একটি শব্দ বা বাক্যকে কেন্দ্র করে চাকুরিতে কোটা নিয়ে একটি শান্ত, স্বাভাবিক আন্দোলনের ঢেউ সুনামিতে রুপান্তরিত হলে সান্ধ্যআইন জারি করতে হয়েছিল। মধ্যিখানে নানা কাঠখড় পুড়িয়ে গণদাবির মুখে কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও সেটা শান্তি আনতে পারেনি। বিশেষ করে পুলিশের গুলিতে শত শত কোমলমতি শিক্ষার্থী নিহত হলেও প্রকৃত মৃত্যুসংখ্যা প্রকাশ না করা, ডিবি অফিতে তুলে নিয়ে গিয়ে জবরদস্তি করে ছয় সমন্বয়কের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা এবং নয়দফা দাবি পূরণ না করার কারণে আগস্ট মাসে এসে আবারো ফুঁসে উঠেছিল আন্দোলনকারীরা।
Advertisement
নির্বাহী আদেশে জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে আবারো এটা নতুন রাজনৈতিক শক্তি ধারণ করেছে। আগস্ট ০২, ২০২৪ শিক্ষার্থী-জনতা, রাজনৈতিক-পেশাজীবী দল সমর্থনপুষ্ট হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লক্ষ লক্ষ মানুষের এক অভূতপূর্ব সমাবেশে দাবি উঠে সরকার হটাও করার। ঘোষিত হয় সরকার পতনের একদফা দাবি। কিন্তু আগস্ট ০৪, ২০২৪ তারিখে পুনরায় আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে শতাধিক আন্দোলনকারীকে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। ক্ষিপ্ত জনতা ১৪ জন পুলিশকে পিটিয়ে মেরে ফেরে। সেদিন সন্ধ্যে ৬টা থেকে পুনরায় কারফিউ জারি করে কঠোরতার নির্দেশ দেয়া হয়। ইন্টারনেট সেবা পুনরায় বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশের মানুষ গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। তখন একবাক্যে সেটাকে শান্ত করে জনমনে স্বস্তি ও দ্রুত একটি সুস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করার কোনো সহজ উপায় ছিল না।
কোটা সংস্কার কোনো দলীয় বা রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। দলমত নির্বিশেষে এটা সকল শিক্ষার্থীর আন্দোলন। রাজাকারের ‘নাতিপুতি’ নামক শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে খোটা দেয়ার পর এর গতি নতুন দিকে মোড় নেয়। আন্দোলনকারীরা এটাকে অপবাদ ও চরম অপমানজনক হিসেবে ধরে নেয়ায় এটা তাদের আন্দেলনে আগুন জ্বেলে দেয়। কোটা আন্দোলনকারীদেরকে দমন করার জন্য ‘শুধু ছাত্রলীগ’বা একটি ছাত্রসংগঠনই যথেষ্ট অথবা, ‘আন্দোলন করে করে ওরা ক্লান্ত হোক তখন দেখা যাবে।’ এমন মন্তব্য আরো বেশি উস্কে দিয়েছে তাদের এই অভিমানকে। এতে ক্ষোভের আগুনে বুক পেতে দিয়ে পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ছাত্র সাঈদ। আন্দেলনে ভস্মে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল চারদিক।
ক্ষোভের আগুনে বুক পেতে দিয়ে পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ছাত্র সাঈদ। আন্দেলনে ভস্মে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল চারদিক।
Advertisement
আন্দোলনকারীদের এই খোটা খাওয়ার দুঃখ, কষ্ট, অভিমানকে সরকারী মহলের কেউই পাত্তা দেননি। বরং বিভিন্ন উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়ে তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে সরকারী ছাত্রসংগঠন থেকে আরো দূরে ঠেলে দিয়েছেন। ষোল দিন পরে এ থেকে ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করে। তাদেরকে লুফে নিয়ে এটাকে বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের ব্যানারে ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে, সারা পৃথিবীতে। তাদের সমর্থক বেড়ে লক্ষ কোটি জনতায় পরিণত হয়ে পড়ে।
তারা মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট স্মারকলিপি দিয়ে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা শুরু করে। সেখানে কিছুটা আশ্বাস পেলেও তা তৎক্ষণিকভাবে কোন সুফল বয়ে আনেনি। ফলে আন্দোলন আরো গতিপ্রাপ্ত হয়ে নতুন দিকে মোড় নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো হঠাৎ ভ্যাকেট করে দেয়া হয়। সারাদেশের সকল স্কুল, কলেজ, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে বন্ধ ঘোষিত হয়। সারা দেশে আন্দোলনের গতি ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার সাথে দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পুলিশের সাথে র্যাব, বিজিবি-কে মাঠে নামানো হয়। গত ১৮ জুলাই এসকল বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় অজানা সংখ্যক মানুষ।
অন্যদিকে এই আধুনিক যুগে আন্দোলন দমনের নামে সারাদেশে ইন্টারনেট ও ফোরজি মোবাইল সেবা বন্ধ করে দিলে সবাই ঘরের বাইরে বের হয়ে পড়েছিল। এটাকে শাঁখের করাত হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাহলগুলো ভ্যাকেট করে দেয়ায় তারা বাধ্য হয়ে অন্যত্র চলে যায়। তারা নিকটস্থ বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল বা মেসে অবস্থান নেয়। সেখানে তাদের বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিতজনদের আশ্রয়ে থেকে আন্দোলনকে আরো বেশী শাণিত করায় রাজধানীর উত্তরা, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, সাভার ইত্যাদিতে তারা ছড়িয়ে থেকে ১৮ জুলাই আরো সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা নিজেদের অজান্তেই বিরোধী রাজনৈতিক দল, শ্রমিক, রিক্সাচালক, সন্ত্রাসী, সুযোগসন্ধানীদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে পিকেটিং করে, ধ্বংসযজ্ঞে শামিল হয়ে যায়। পুলিশও সেখানে মারমুখি হয়ে উঠে গুলি, গ্যাস ছোঁড়ায় যুদ্ধ বেঁধে যায়। পুলিশের সাঁজোয়া যান ছাত্রদের মিছিলে উঠে গিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই নির্মম ঘটনায় কতসংখ্যক নিহত হয়েছে তার প্রকৃত পরিসংখ্যান জানা যায়নি। এই ঘটনায় আহত ও মৃত্যুসংখ্যা আগস্ট ০৮,২০২৪ তারিখে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও প্রকৃত সংখ্যা সঠিকভাবে কেউ জানাতে পারেননি।
এমন বিষাদময় পরিস্থিতি তখন সরকারী গণমাধ্যমে অতি নেতিবাচকভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। যা দেশ ও জনগণ উভয়ের জন্য চরম ক্ষয়-ক্ষতি বয়ে এনেছে। কিন্তু কেন এমন হলো? এতগুলো অল্পবয়সী শিশু-কিশোর কেন নিহত হলো? এসব শিশু-কিশোররা পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল। তারা সাবেক হাসিনা ও তার মন্ত্রীদের খোটা, তকমা সহ্য করতে না পেরে সাথে থাকা মোবাইল ফোন, ট্যাব, নোটবুক, ইত্যাদি দিয়ে তাদের সহপাঠী ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে আন্দোলনে শামিল হয়। তারা কোটা আন্দোলনের আগে সরকারের খোটা, তকমা ইত্যাদিকে একধরনের বুলিং, টিজিং মনে করে তাদের অভিমানের সুরে নিজেদেরকে মিলিয়ে দিয়ে দুর্বার গতিতে রাস্তায় নেমে পড়েছিল।
Advertisement
সে সময় তাদের ভয়ে পুলিশ আত্মগোপনে চলে গেলে রাস্তার পুলিশি পাহারা না থাকায় উত্তেজিত জনতা একসময় ‘মব’ বা মারমুখী জনতা হয়ে উঠে। তাদের একক কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃত ও আহতদের এক পরিসংখ্যানে দেখ গেছে তারা শতকরা ৭৮ ভাগ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। রাজনীতি না করেও তারা রাজনৈতিক মামলার শিকার হয়েছে।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ঘটনার রুটকে আমলে না নিয়ে ডালপালা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এর শিকড় আরো গভীরে প্রবেশ করে মহীরুহ হয়ে পড়েছে। এর বিস্তৃতি সামলাতে দেশের আইনশৃংখলা বাহিনী অপারগ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে শেষপর্যন্ত মারমুখী জনতা ঠেকাতে সারা দেশে সান্ধ্যআইন জারি করে যৌথভাবে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছিল।
ততক্ষণে প্রকাশিত হয় শত শত কচিপ্রাণের হত্যাকান্ড, অজানা সংখ্যক লাশের গণকবরের সন্ধান, পুনরায় কারফিউ জারি হয়। অনির্দিষ্ট কালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলা ও ইন্টারনেট-মোবাইল সেবা বন্ধ করা ইত্যাদির কারণে বিপুল পরিমাণ জান-মালের ধ্বংসলীলা ঘটে যায়।
সরকারীভাবে ৬৫০ জনের কথা বলা হলেও হাজারো শিক্ষার্থী-জনতাকে হত্যা, ৪২ পুলিশের মৃত্যু এবং অজানা সংখ্যক আহত করায় গত দেড় মাসাধিককাল যাবত দেশে-বিদেশে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়ে গেছে সেই আস্থা ফেরানোর জন্য গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তবে এর মূল চালকের আসনে দেশের তরুণ সমাজ। তাদের প্রাপ্তিকে নস্যাৎ করতে বার বার প্রতিবিপ্লব ঘটানোর চেষ্ট করা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশে বসে গুজব ছড়িয়ে বার বার উস্কানী দিচ্ছে পলাতক নেতারা। দেড়মাস পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেবার ঘোষণা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে নিয়োগের নীতিমালা কি হবে তা স্পষ্ট করা যায়নি। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানিয়ে শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছেন জাতিসংঘ এবং চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কাসহ আরো অনেক দেশ।
গত আন্দোলনে ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক ক্ষত ও ক্ষতি পূরণ করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এগুলো কাটিয়ে ওঠা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। যে কেউ একটিমাত্র শব্দ বা বাক্যে ব্যবহারের মাধ্যমে ত্বরিৎ গতিতে চরম অস্বস্থি ও অরাজকতা তৈরি করতে পারে কিন্তু একটি বাক্যের ঘোষণা দিয়ে সবার জন্য শান্তি ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ নয়। এজন্য অবশ্যই প্রয়োজনীয় সময় দিয়ে কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/জিকেএস