অর্থনীতি

জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসির বকেয়া ৭ হাজার কোটি, সংকটের আশঙ্কা

• হতে পারে ক্রুড অয়েলের সংকট• ইআরএল বন্ধের আশঙ্কা• বকেয়া না পেয়ে নতুন চালান পাঠাতে অনীহা সরবরাহকারীদের

Advertisement

জ্বালানি তেল নিয়ে আরও ঘণীভূত হচ্ছে শঙ্কা। ডলার সংকটে বিদেশি জ্বালানি সরবরাহকারীদের বকেয়া পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। গত ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সরবরাহকারীদের বকেয়া ৫৫৮ মিলিয়ন ডলার (১ ডলার সমান ১২৫ টাকা ধরে ৭ হাজার কোটি প্রায়)।

অথচ বিপিসির কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি নগদ অর্থ বিভিন্ন তফশিলি ব্যাংকে জমা রয়েছে বলে জানান বিপিসির কর্মকর্তারা। আমদানিতে সংকট দেখা দিলে উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় পড়বে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড।

বিপিসির তথ্যমতে, বিদেশি ছয় প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে জ্বালানি তেল সরবরাহ করে। সবচেয়ে বেশি বকেয়া সিঙ্গাপুরভিত্তিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের। গত ১৪ আগস্ট পর্যন্ত বিপিসির কাছে প্রতিষ্ঠানটির পাওনা ২০২ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বকেয়া আইটিএফসির (ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফিন্যান্স করপোরেশন)। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের কিস্তির পাওনা বকেয়া পড়েছে ১০৩ মিলিয়ন ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ পাওনাদার ইউনিপেক সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিপিসির দেনা ৫৯ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার।

Advertisement

অন্য সরবরাহকারীদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পিটি ভূমি ছিয়াক পোছাকো (বিএসপি) প্রায় ৪৭ মিলিয়ন ডলার, ভারতের ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেড (আইওসিএল) প্রায় ৩৪ মিলিয়ন ডলার, আরব আমিরাতের অ্যামিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ইনোক) প্রায় ২৮ মিলিয়ন ডলার এবং মালয়েশিয়ান সরবরাহকারী পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি লিমিটেড (পিটিএলসিএল) পাবে প্রায় ২৩ মিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুন

এসএওসিএলে দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নেই বিপিসির ৯ বছর ঝুলে আছে বিপিসির ৭৫ লাখ টনের রিফাইনারি নির্মাণ পরিকল্পনা ৪৭ বছর ধরে ‘পরের ঘরে’ বিপিসি

বিপিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বকেয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকায় সরবরাহকারীরা এরই মধ্যে সামনের পার্সেলগুলো পাঠানোর ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে আইটিএফসির ঋণের কিস্তি শোধ করা না গেলে ক্রুড অয়েলের সংকট হতে পারে। তাতে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) প্ল্যান্ট বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশি সরবরাহকারীদের বকেয়া বিলের চাপ সামাল দিতে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে ১৪ আগস্ট ভার্চুয়াল সভা করেন বিপিসি চেয়ারম্যান।

বিপিসি সূত্রে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১ এপ্রিল সোনালী ব্যাংকের ঋণপত্রের বিপরীতে অকটেনের একটি চালান সরবরাহ করে ভিটল এশিয়া। ওই চালানে অকটেনের মূল্য ২৪ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলার। নিয়ম অনুযায়ী ২৮ এপ্রিলের মধ্যে মূল্য পরিশোধের কথা। কিন্তু গত ২৬ জুন থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ৬ কিস্তিতে ১১ দশমিক ০১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে বিপিসি। ওই চালানের অবশিষ্ট বকেয়া ১৩ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার। ওই পার্সেলের বিল পরিশোধের সময় পেরিয়েছে ১০৪ দিন (১৪ আগস্ট পর্যন্ত)।

Advertisement

গত ২৯ মে অগ্রণী ব্যাংকের আরেক এলসির বিপরীতে ডিজেলের একটি চালান সরবরাহ করে ভিটল এশিয়া। চালানটির জাহাজভাড়াসহ মূল্য ২৫ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলার। ওই চালানের বিল পরিশোধের নির্ধারিত মেয়াদ ছিল ৪ জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ওই চালানের কোনো বিল পরিশোধ করতে পারেনি বিপিসি।

ওআইসির সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আইটিএফসির ঋণ সহায়তায় ক্রুড অয়েল আমদানি করে। চলতি মাসে বিপিসির কাছে ঋণের কিস্তি বকেয়া পড়েছে ১০৩ মিলিয়ন ডলার, যা পরিশোধ করা না গেলে পরবর্তী ক্রুড অয়েলের চালান আমদানি ব্যাহত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিপিসি সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বকেয়া আদায়ের জন্য চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বহির্নোঙরে আসা জাহাজ থেকে জ্বালানি খালাস আটকে দিয়েছিল ভিটল এশিয়া এবং ইনোক। জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টদের ভাষায় তাকে ফিন্যান্সিয়াল হল্ট বলা হয়। পরে প্রতিষ্ঠান দুটির দেশি লোকাল এজেন্টের সঙ্গে বিল পরিশোধে আশ্বাস দেওয়া হলে তারা ফিন্যান্সিয়াল হল্ট তুলে নেন। পরে জাহাজ দুটি থেকে জ্বালানি খালাস করা হয়।’

বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকে ডলার সংকটের কারণে বিদেশি সরবরাহকারীদের পেমেন্ট নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মণিলাল দাশ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে ৫৫৮ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে ভিটল এশিয়ার রয়েছে প্রায় ২২০ মিলিয়ন ডলার, আইটিএফসির ঋণের কিস্তি রয়েছে ১০৩ মিলিয়ন ডলার। আমাদের পর্যন্ত নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা রয়েছে। শুধু ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক এলসির অর্থ পরিশোধ বিলম্বিত হচ্ছে। আমরা আমাদের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। আমরা মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে কথা বলছি। যাতে জ্বালানি তেলের বিলের বকেয়া নিয়মিতভাবে পরিশোধ করতে পারি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের ইস্টার্ন রিফাইনারি পুরোপুরি ক্রুড অয়েলনির্ভর। ক্রুড অয়েল আমদানি হয় আইটিএফসির মাধ্যমে। এখন ক্রুড অয়েল আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে রিফাইনারির প্ল্যান্ট বন্ধ রাখা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম