জাতীয়

যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন চোখে গুলি লেগে আহতরা

   

গুলির ক্ষত নিয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আছেন মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা কাজী ফারুক। ৩৪ বছর বয়সে দুই চোখের দৃষ্টি হারাতে বসেছেন তিনি। শেখ হাসিনার সরকার পতনের আন্দোলনে অংশগ্রহণকালে চোখে গুলি লাগে তার। বাবা-মা বেঁচে নেই, ঘরে স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। ফারুকের জীবনশঙ্কা ভাবিয়ে তুলেছে আত্মীয়-স্বজনদের।

Advertisement

রোববার (১৮ আগস্ট) জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালে ভর্তি আছেন ফারুকের মতো আরও অনেকে। তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তারা। আন্দোলনকালে তাদের কারও দুই চোখ, কারও এক চোখ গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

আরও পড়ুন বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৬৫০ আমাদের কলিজার ওপর দিয়ে গাড়ি গেছে, কঠিন বিচার চাই ফুসফুসে ক্ষত, হাসপাতালে ধুঁকছেন আহতরা

চিকিৎসাধীন রোগীদের চোখে-মুখে জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তার ছাপ। তবে তাদের রক্তের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, এটুকুই স্বস্তি, বলছেন স্বজনরা।

ফারুকের সঙ্গে যা ঘটেছিল ৫ আগস্ট

শেখ হাসিনার সরকার পতনে ৫ আগস্ট ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে একাট্টা হয়েছিল ছাত্র-জনতা। স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয় লাখো মানুষ। অন্যদের মতো রাজধানীর রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে আন্দোলনে অংশ নেন ফারুক। এসময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘাত শুরু হলে গুলি এসে লাগে তার দুই চোখে।

Advertisement

‘আমার ভাইগ্না দেশের জন্য নিজের চোখ দিলো। কিন্তু যে দেশটা আবার স্বাধীন হলো তা আর নিজের চোখে দেখতে পারবে না।’ গুলিবিদ্ধ কাজী ফারুকের মামা মো. আরিফ

ফারুকের মামা মো. আরিফ জাগো নিউজকে বলেন, তার ভাগ্নে গুলশান-২ এর ক্যাপিটাল ক্লাবে চাকরি করেন। তার মা-বাবা বেঁচে নেই। ভাই-বোনও নেই। তাদের সঙ্গেই থাকেন চিটাগাং রোডের বাসায়। তার সংসারে ৫ বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।

আন্দোলনের প্রথম থেকেই ছাত্রদের নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছিলেন কাজী ফারুক। ৫ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে ছয়টি গুলিতে বিদ্ধ হয় তার দুই চোখ। এরপর হাসপাতালে দুটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। চোখে এখনও যে গুলি আছে তা বের করা জটিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

‘পরিবারের সবার দায়িত্বই আমার ওপরে। এমন অবস্থায় এমনটা হলো। পুরো পরিবারের দেখভাল কীভাবে করবো জানি না। আফসোস করছি না। দেশে এখন শান্তিভাব আছে, সেটাই বড় বিষয়।’ গুলিবিদ্ধ রহমাতুল্লাহ সরদার সাব্বির

Advertisement

মো. আরিফ বলেন, “গুলি খাওয়ার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কেন গেছস? নিজের চোখ হারাইলি। সে বলে, ‘মামা নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি’।”

আরও পড়ুন পরিচয়পত্রটি তার পকেটে ছিল রক্তে ভেজা ১৭ জুলাই সাঈদের ছবি পোস্ট, দুদিন পর নিজেই গুলিতে নিহত হন মামুন রাস্তায় বেরোতেই হঠাৎ কী যেন এসে পেটে লাগে, হাত দিয়ে দেখি রক্ত রিয়াজদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না: আসিফ মাহমুদ  ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে সরকার 

‘আমার ভাইগ্না দেশের জন্য নিজের চোখ দিলো। কিন্তু যে দেশটা আবার স্বাধীন হলো তা আর নিজের চোখে দেখতে পারবে না।’ বলছিলেন কাজী ফারুকের মামা।

এক চোখ হারিয়েছে, আরেক চোখে ঝাপসা দেখছেন সাব্বির

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় গুলিতে এক চোখ হারিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশালের অন্যতম সমন্বয়ক রহমাতুল্লাহ সরদার সাব্বির। বরিশাল ল কলেজের শিক্ষার্থী সাব্বির আরেক চোখে ঝাপসা দেখছেন। বাবা নেই পরিবারে। তিন ভাই তারা। বড় ভাই বেকার হওয়ায় নিজেই পরিবারের হাল ধরেছেন। টিউশনি করিয়ে সংসার খরচ চালান। অথচ সাব্বিরের জীবনই এখন দিশাহারা।

পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে গলিতে খেলার সময় গুলি লাগে জেমরানের চোখে-মুখে।-মা পান্না বেগম

৪ আগস্ট কী ঘটেছিল সাব্বিরের সঙ্গে?

গত ৪ আগস্ট বরিশাল বিএম কলেজ-সিএনবি চৌমাথার সামনে ছাত্রদের আন্দোলনে পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন সাব্বির। শুরুতে স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরে রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে আনা হয় তাকে। সেই থেকে হাসপাতালের শয্যায় কাটছে তার জীবন।

সাব্বির বলেন, ‘পরিবারের সবার দায়িত্বই আমার ওপরে। এমন অবস্থায় এমনটা হলো। পুরো পরিবারের দেখভাল কীভাবে করবো জানি না। আফসোস করছি না। দেশে এখন শান্তিভাব আছে, সেটাই বড় বিষয়।’

‘আমার সন্তানের বয়সী ছেলেরা আহত হচ্ছে। নিজেকে ধরে রাখার সুযোগ ছিল না। হাসপাতালের চিকিৎসকরা সবাই এগিয়ে এসেছিলেন। কিছু লোক ইনডিরেকটলি অসহযোগিতা করলেও সামনা-সামনি কেউ ঝামেলা করেনি।’ ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল

বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে চোখে গুলি লাগে শিশু জেমরানের

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পঞ্চম তলার ৫০৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ১০ বছর বয়সী শিশু জেমরান। তার বাঁ চোখের পাপড়ি, কান, মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ছররা গুলির চিহ্ন দেখা যায়। তার মা পান্না বেগম জানান, পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে গলিতে খেলার সময় গুলি লাগে জেমরানের চোখে-মুখে।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্র বলছে, গত ১৭ জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ৭৪০ জন আহত রোগী হাসপাতালে চোখের চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ভর্তি হয়েছিলেন ৬১০ জন। অস্ত্রোপচার হয়েছে ৪৯৫ জনের। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৫২ জন। চিকিৎসা নেওয়াদের মধ্যে এক চোখ হারিয়েছেন ৩৬৬ জন। আর দুই চোখ হারিয়েছেন ১৭ জন। এ ছাড়া গুরুতর দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন ৩৮ জন আর কম দৃষ্টি স্বল্পতার সমস্যায় ভুগছেন ১৫৮ জন।

সংকটময় পরিস্থিতিতে সরাসরি চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন চিকিৎসক রেজওয়ানুর রহমান সোহেল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যখন সারাদেশে আন্দোলন চলছিল, সেই মুহূর্তে বলা যাচ্ছিল না কী হতে যাচ্ছে। আর একের পর এক চোখে আঘাত পাওয়া রোগী হাসপাতালে আসছিল। সে সময় হাসপাতালে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ফোন করে হুমকিও দেওয়া হয়, বলা হয় কেনো চিকিৎসা দিচ্ছি। তবে সেসময় এসব রোগীর যাতে ঝামেলা না হয় আমরা পুলিশ কেইস উল্লেখ করে ভর্তি বা চিকিৎসা দেইনি, সবাই মিলে চিকিৎসা দিয়েছিলাম। আমরা অনেক ঝুঁকি নিয়েছিলাম। হয়তো এই সরকার থাকলে আমাদের জেলেই নিতো।’

ডা. সোহেল আরও বলেন, ‘আমার সন্তানের বয়সী ছেলেরা আহত হচ্ছে। নিজেকে ধরে রাখার সুযোগ ছিল না। হাসপাতালের চিকিৎসকরা সবাই এগিয়ে এসেছিলেন। কিছু লোক ইনডিরেকটলি অসহযোগিতা করলেও সামনা-সামনি কেউ ঝামেলা করেনি।’

এএএম/এসএনআর/এমএমএআর/জিকেএস