জাতীয়

৫৪ লাখ টাকার কম্পিউটার সামগ্রীর মেরামত ব্যয় ৫০ লাখ!

একটি প্রস্তাবিত প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদকাল ৪ বছর ১০ মাস। প্রকল্পের মূলধন অংশে কম্পিউটার অ্যাক্সেসরিজ বাবদ ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৫৪ লাখ টাকা। এসব কম্পিউটার সামগ্রী মেরামতের জন্যও ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সমপরিমাণ, ৫০ লাখ টাকা। মেরামত বাবদ এই ব্যয় প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। প্রকল্পের অন্য অনেক ব্যয় প্রস্তাব নিয়েও কমিশন সন্তুষ্ট নয়।

Advertisement

‘সমন্বিত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পে’ এমন ব্যয় প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর উচ্চবিত্ত পরিবারে সদস্যপ্রতি গড়ে দৈনিক কঠিন বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ ৪৯৬ গ্রাম। মধ্যবিত্ত পরিবারে তা ৪৮৩ গ্রাম ও নিম্নবিত্ত পরিবারে ১৯৩ গ্রাম। এই বর্জ্যের বড় অংশ খাদ্যবর্জ্য। এভাবে বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় দৈনিক সাড়ে ৭ হাজার টনের বেশি কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। সারাদেশের কথা বিবেচনা করলে দৈনিক উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ আরও বেশি।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় নানা ধরনের প্রকল্প চলমান। অথচ প্রচলিত এ কাজ বাস্তবায়ন করতে নতুন প্রকল্পের আওতায় ১৪৬ কোটি টাকার ব্যয় প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সংশ্লিষ্ট বিভাগের এমন প্রস্তাবনায় যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না পরিকল্পনা কমিশন। এজন্য প্রস্তাবিত ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি।

পরিকল্পনা কমিশন যখন বিষয়টি ধরেছে তখন যেভাবে বলবে সেভাবে তারা পুনরায় ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) পুনর্গঠন করে দেবে।- স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান

Advertisement

কম্পিউটার খাতে ব্যয় প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের (পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগ) মহাপরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কী পরিমাণে কম্পিউটার ব্যবহার হবে, এটা দেখতে হবে। এছাড়া কী পরিমাণে জনবল লাগবে এটাও দেখতে হবে।’

আরও পড়ুনবজ্রপাতে মৃত্যু রোধে ১৩২১ কোটি টাকা চেয়ে মিললো ১০০ কোটি!শুরুই হয়নি ৩৪ বাফার গুদামের নির্মাণকাজ, ব্যয় ৩২২ কোটিব্যয়-মেয়াদ বাড়িয়েও নির্মাণে ‘ফাঁকি’, ঝুঁকিতে রেলপথ

৫৪ লাখ টাকার কম্পিউটার মেরামতে ৫০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশন যখন বিষয়টি ধরেছে তখন যেভাবে বলবে সেভাবে তারা পুনরায় ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) পুনর্গঠন করে দেবে।’

পরামর্শক ব্যয় নিয়ে ক্ষোভ‘সমন্বিত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় পরামর্শক (ফার্ম) ২ হাজার ৫৭৬ জনমাসের জন্য ১৩৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং পরামর্শক (ব্যক্তি) বাবদ ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এত বেশি পরামর্শক ব্যয় প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নেই বলে দাবি কমিশনের। প্রচলিত কাজে ফের এত বেশি পরামর্শক ব্যয় ধরার জন্য ক্ষুব্ধ কমিশন।

প্রকল্পটির মোট ব্যয় ২ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্রমণ বাবদ ১ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে জানায় কমিশন। স্ট্যাম্পস ও প্রিন্টিং বাবদ এক কোটি, সিল ও স্ট্যাম্প বাবদ ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, অন্য সরঞ্জামাদি বাবদ ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অত্যধিক ব্যয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কমিশন।

Advertisement

প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকারাজশাহী, রংপুর ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং ভোলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী, মুন্সিগঞ্জ, মিরকাদিম, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, করিমগঞ্জ, ফরিদপুর, মাগুরা ও কুষ্টিয়া পৌরসভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া কুষ্টিয়ার মিরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজশাহীর নওহাটা, কাটাখালী, নওগাঁ, হারাগাছা, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও মৌলভীবাজার পৌরসভাও থাকছে তালিকায়।

একই ধরনের কাজ যদি দেশে বাস্তবায়িত হয় তবে এত বেশি পরামর্শক ব্যয় ধরা সমীচীন হবে না। এটা দেখেই বুঝবো প্রয়োজন ও নীতিমালায় যতটুকু কভার করে, সেটুকু অনুমোদন দেবো। প্রয়োজনের অধিক পরামর্শক ব্যয় রাখবো না।- ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান

ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘একই ধরনের কাজ যদি দেশে বাস্তবায়িত হয় তবে এত বেশি পরামর্শক ব্যয় ধরা সমীচীন হবে না। এটা দেখেই বুঝবো প্রয়োজন ও নীতিমালায় যতটুকু কভার করে, সেটুকু অনুমোদন দেবো। তবে ঋণের প্রকল্পের ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শক লাগে, তা না হলে তত্ত্বাবধান করার লোক থাকে না। তারপরও প্রয়োজনের অধিক পরামর্শক ব্যয় রাখবো না।’

প্রকল্পের উদ্দেশ্যস্থানীয় সরকার বিভাগ জানায়, প্রকল্পের আওতাভুক্ত নির্বাচিত সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেবার উন্নতি করা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়া দেশে কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ ও চূড়ান্ত অপসারণের ক্ষেত্রে সুব্যবস্থাপনায় অভাব রয়েছে। অনেক নগর এলাকায় সুপরিকল্পিত বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা নেই। বসতবাড়ি থেকে উৎপন্ন কঠিন বর্জ্য প্রায়ই খোলা জায়গা, জলাশয়, পানি নিষ্কাশন নালায় এমনকি পথে-ঘাটে ফেলে রাখা হচ্ছে। কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ ও চূড়ান্ত অপসারণ করে একটি সমন্বিত ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নগর এবং শহরে বাস্তবায়ন করা জরুরি। এ লক্ষ্যে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হচ্ছে।

পরিকল্পনা কমিশনের যত আপত্তিপ্রস্তাবিত প্রকল্পের বিষয়ে কিছু আপত্তি তুলেছে কমিশন। প্রকল্পে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোর ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। সমন্বিত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি সিটি করপোরেশন-পৌরসভার রয়েছে কি না সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া মালিকানা বা ভূমি সংক্রান্ত কোনো জটিলতা রয়েছে কি না তা প্রকল্প অনুমোদনের আগেই এলজিইডি থেকে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

যেহেতু কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আবশ্যক। সমন্বিত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এক্সিট প্ল্যান থাকা প্রয়োজন। সিটি করপোরেশন পৌরসভাগুলোর সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের সমঝোতা সই করা হবে কি না এবং করা হলে কীভাবে এগুলো ব্যবস্থাপনা করা হবে তা স্পষ্ট নয়। যে এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে তার জনসংখ্যার সার্বিক চিত্র জানতে হবে।

প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ২০৮টি যানবাহন এবং ৪৮টি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করার বিষয়ে অর্থ বিভাগের সম্মতি প্রয়োজন। সমন্বিত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে তার ড্রয়িং ডিজাইন ও থ্রিডি ভিউ ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। পুনর্বাসন বাবদ ৩০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। কোন কোন এলাকায় এই পুনর্বাসন করা হবে, কোন পদ্ধতিতে করা হবে, কাদের মাধ্যমে এই ক্ষতিপূরণের টাকা বণ্টন করা হবে এবং কারা ক্ষতিপূরণ পাবে তার একক, পরিমাণ ও টাকাসহ তালিকা টেবিল আকারে ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই।

প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে করানো হয়েছে তা জানা জরুরি। প্রকল্পে পেট্রোল অয়েল এবং লুব্রিক্যান্ট বাবদ সাড়ে ৭ কোটি টাকা, গ্যাস ও ফুয়েল বাবদ ২ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের সম্মতি নিতে হবে বলেও উল্লেখ করেছে কমিশন।

এমওএস/এএসএ/জেআইএম