বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার নেতৃত্ব ও ত্যাগ ছিল অপরিসীম। শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন।
Advertisement
তবে, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেন।
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে এসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে, ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হন।
শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল ও বিতর্কশেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও, তার শাসনকাল শুরু থেকেই নানা সংকটে জর্জরিত ছিল। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন এবং দেশের একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে তার প্রতি জনগণের আস্থা ও সমর্থন ক্ষীণ হতে শুরু করে। বাকশাল ছিল সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে এককভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি প্রচেষ্টা, যা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বিনষ্ট করে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থা দেশের মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সমালোচনাকে সীমাবদ্ধ করেছিল।
Advertisement
এছাড়া, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের চরম অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি এবং খাদ্যাভাবও জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এসব কারণে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা কমে যায় এবং তার শাসনকাল বিভিন্ন বিতর্কের মধ্যে পতিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, একটি সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
শেখ মুজিবের হত্যার পর তার কন্যা শেখ হাসিনা রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে পুনরায় নির্বাচিত হন। তবে, দীর্ঘ শাসনকালেও তাকে বিভিন্ন বিতর্ক এবং সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
শেখ হাসিনা প্রশাসনকে ব্যবহার করে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে। তার শাসনামলে ছাত্রসমাজকে সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দিয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় স্বৈরশাসন তৈরি করেছেন। প্রশাসনের কেন্দ্রে ‘আয়নাঘর’ নামক একটি দুর্বৃত্তায়নমূলক কাঠামো তৈরি করে তিনি শত শত জীবন নাশের পেছনে দায়ী হয়েছেন। এই অন্ধকারময় শাসনব্যবস্থা এবং জনগণের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টার ফলে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে, শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের প্রতি অতিরিক্ত মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টা দেখা গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে দেবতুল্য সম্মান দেওয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে তার ভাস্কর্য স্থাপন, পুস্তক প্রকাশনা, চলচ্চিত্র নির্মাণ ইত্যাদি। এই প্রচেষ্টা, যদিও পরিবারের ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহায়তা করেছে, তবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা জন্ম দিয়েছে।
Advertisement
এই পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায় যখন শেখ হাসিনা প্রশাসনের কেন্দ্রে থাকা ‘আয়নাঘর’ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নমূলক নীতির মাধ্যমে দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। প্রশাসনকে ব্যবহার করে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা এবং বিরোধী দলকে দমন করার ফলে দেশজুড়ে গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এর পরিণতিতে, জনগণ এবং ছাত্রসমাজ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি যে শ্রদ্ধা একসময় ধরে রেখেছিল, তা ক্রমে লুপ্ত হয়ে যায়।
এভাবে, দীর্ঘদিনের ক্ষমতা ধরে রাখার প্রচেষ্টায় শেখ হাসিনা তার বাবার নামকে আজীবনের জন্য জনগণের হৃদয় থেকে মুছে দিয়েছেন এবং অবশেষে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
ভবিষ্যতে যারা রাজনীতি করবেন, তাদের উদ্দেশ্যে শেষ কথা হলো যে ইতিহাস তৈরি হয়েছে, তার যেন আর পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে না হয়। রাজনীতি করতে হবে দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য, নিজের জন্য নয়—তা না হলে ফল কী হবে, তা শেখ পরিবারের উদাহরণ থেকেই দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু যেহেতু এখনও জাতির পিতা, সেহেতু তার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে রাজনীতি করতে হবে।
একটি রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তিকে বা তার পরিবারকে জোরপূর্বক দেবতুল্য সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করলে, সেই সম্মান প্রকৃতপক্ষে অর্জিত হয় না বরং প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভ ও বিদ্রোহের জন্ম দেয়। জনকল্যাণমূলক রাজনীতি করতে হলে ক্ষমতা নয় বরং সত্যিকারের জনসেবা, সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা এবং ন্যায়বিচারের মূল্যবোধ বজায় রাখতে হবে। অন্যথায়, সেই নেতা বা দলের প্রতি প্রজন্মের মানুষের শ্রদ্ধা না থাকায় পরিস্থিতি বিপরীত হতে পারে, যা ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
আমরা একটি ফুলকে বাঁচাতে গিয়ে অস্ত্র ধরেছিলাম, যুদ্ধ করেছিলাম, কিন্তু সেই ফুলটিকে ফোটাতে পারিনি। আজ সেই ফুলটি দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকের কবলে প্রায় মৃত্যুমুখে। ঠিক এই মুহূর্তে তাকে বাঁচানোর জন্য দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সমন্বয়কারীদের নেতৃত্বে আসুন, সেই চারা গাছে নতুন যে ফুলটা এসেছে, তাকে ফোটাতে সবাই সাহায্য করি যার যার জায়গা থেকে। একসাথে কাজ করলে তবেই সেই ফুল পূর্ণতা পাবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জেআইএম