জাতীয়

পুলিশের অস্ত্র লুট নিরাপত্তার জন্য হুমকি, শিগগির অভিযান

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির দিন ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে উত্তেজিত জনতা। লুট হয় পুলিশের কয়েক হাজার অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এখন সাধারণ মানুষের হাত থেকে এসব অস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে চলে যাচ্ছে, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে আসামি পলায়ন এবং থানা-ফাঁড়িতে হামলা করে অস্ত্র লুট আগামী দিনে নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। লাইসেন্সবিহীন এসব অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে গেলেই শুরু হতে পারে অস্থিতিশীল পরিবেশ, যা নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৭১৫টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ১৮ হাজার ৫১২ রাউন্ড গুলি, ১ হাজার ১১৮টি টিয়ার শেল ও ১৭০টি সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে।

র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র‍্যাব) পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করেছে। র‍্যাব এ পর্যন্ত উদ্ধার করেছে ৯৭টি অস্ত্র, ৬ হাজার ৫৮৫ রাউন্ড গোলাবারুদ ও ২৮টি ম্যাগজিন।

Advertisement

বেআইনি লোকদের কাছে কিংবা লাইসেন্স ছাড়া অস্ত্র থাকাটাই বিপজ্জনক। তাদের জন্য ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক। এগুলো দ্রুত উদ্ধার করা দরকার।- সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা

তবে ঠিক কত সংখ্যক অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট হয়েছে সে পরিসংখ্যান দেয়নি পুলিশ। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের দাবি, শিগগির অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান শুরু করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যৌথ অভিযান শুরু করতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অন্যথায় দেশে খুন, ডাকাতি, অপহরণ, চুরি ও ধর্ষণের মতো বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে লুট হওয়া অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা সামনে এসেছে। উদ্ধার না করতে পারলে এসব ঘটনা আরও বাড়বে।

থানা থেকে লুট করা অস্ত্র বিক্রি করতে গিয়ে ধরা যুবক

ফেনী মডেল থানা থেকে লুট হওয়া একটি পিস্তল বিক্রির সময় ধরা পড়েন মো. রুবেল (২৯) নামে এক যুবক। এসময় পিস্তলটিও উদ্ধার করে পুলিশ। ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুহুল আমিন বলেন, ১৪ আগস্ট রাতে ফেনী শহরের শাহীন একাডেমি এলাকায় এক ক্রেতার সঙ্গে দরকষাকষির সময় পিস্তলসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন রুবেল। শুধু একটি নাইন এমএম পিস্তল নয়, রুবেলের কাছ থেকে ১৪ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগজিনও উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন চট্টগ্রামে থানা থেকে লুট হওয়া ২১ অস্ত্র, ২৭৫ গুলি উদ্ধার  ৭ দিনের মধ্যে অবৈধ অস্ত্র জমার নির্দেশ  লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ পুলিশের কাছে হস্তান্তর  পুলিশের লুট হওয়া ৯৭ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করলো র‍্যাব  লুট হওয়া অস্ত্র থানায় জমা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র জমা দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি গ্যাসগান, চায়না রাইফেল, সিগন্যাল লাইট ও শোল্ডার সিগন্যাল লাইট ছিল। সলঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনামুল হক বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সময় হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানায় আন্দোলনকারীরা আক্রমণ করে। ওই সময় কয়েকটি অস্ত্র লুটের ঘটনাও ঘটে। অস্ত্রগুলোর মধ্যে দুটি রাস্তায় ভেঙে ফেলেন তারা। সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে কয়েকজন হাটিকুমরুল ইউনিয়নের পাঁচলিয়া এলাকার ইউপি সদস্য শাহ আলীর কাছে জমা রাখেন। অস্ত্রগুলো ইউপি সদস্য ও আন্দোলনে যুক্ত কামরুল হাসান এবং নাজমুল হাসানসহ কয়েকজন ছাত্র সলঙ্গা থানায় জমা দেন।

Advertisement

লুট করা অস্ত্র নিয়ে টিকটক করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবকের মৃত্যু

ফরিদপুরের সদরপুর থানা থেকে লুট করা অস্ত্র নিয়ে তিন বন্ধু টিকটক ভিডিও করতে গিয়ে ‘অসাবধানতাবশত’ গুলিবিদ্ধ হয়ে পলাশ হোসেন (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। গত ১২ আগস্ট ঢাকা নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান পলাশ। গত ৬ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন তিনি।

দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে। এখন পর্যন্ত সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৭১৫টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।- পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর

থানা-কারাগারের লুট হওয়া অস্ত্র সেনাক্যাম্পে জমা দেওয়ার অনুরোধ

৯ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের কিছু ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে কারও কাছে রক্ষিত এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ অথবা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকলে দ্রুত নিকটস্থ সেনাক্যাম্পে জমা অথবা যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেআইনি লোকদের কাছে কিংবা লাইসেন্স ছাড়া অস্ত্র থাকাটাই বিপজ্জনক। তাদের জন্য ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক। এগুলো দ্রুত উদ্ধার করা দরকার।’

সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘লাইসেন্সবিহীন অস্ত্র অন্যদের হাতে থাকা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অনেকেই খেলার ছলে কিংবা রাগের জন্য অস্ত্র নিয়ে গেছে। তারা হয়তো ফেরত দেবে। এরপর দেখতে হবে কোন ইউনিট থেকে কতগুলো অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। পুলিশের কিছু সোর্স আছে, সেসব সোর্স মেনটেইন করে তথ্য নিতে হবে। যাচাই-বাছাইয়ের পর অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান করতে হবে।’ 

র‍্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশে পুলিশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ লাইনস থেকে লুট করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ স্বেচ্ছায় নিকটস্থ র‍্যাব কার‍্যালয়/ব্যাটালিয়নে ফেরত দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৯৭টি অস্ত্র, ৬৫৮৫ রাউন্ড গোলাবারুদ ও ২৮টি ম্যাগজিন উদ্ধার করেছে র‍্যাব। এর মধ্যে র‍্যাব-৭ ৩৫টি অস্ত্র, ২৭৫ রাউন্ড গোলাবারুদ, ৮টি সাউন্ড গ্রেনেড ও ৫টি ম্যাগজিন। র‍্যাব-১০ ৯টি অস্ত্র, ৬৬১ রাউন্ড গোলাবারুদ, ৯টি সাউন্ড গ্রেনেড ও মাল্টিটিয়ার গ্রেনেড এবং ১০টি ম্যাগজিন। র‍্যাব-১১ ১০টি অস্ত্র, ৭৭ রাউন্ড গোলাবারুদ, ৪টি সাউন্ড গ্রেনেড ও ২টি ম্যাগজিন। র‍্যাব-১২ ৪৩টি অস্ত্র, ৫৫৫৯ রাউন্ড গোলাবারুদ ও ১১টি ম্যাগজিন উদ্ধার করেছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে। এখন পর্যন্ত সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৭১৫টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। নিকটস্থ থানায় অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি আমরা।’

১৯ আগস্টের মধ্যে অস্ত্র জমা না দিলে ‘উদ্ধার অভিযান’

১৯ আগস্টের মধ্যে জমা না দিলে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘১৯ আগস্টের পর কারও কাছে অস্ত্র পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি জমা না দেন তাহলে দুটি অপরাধ গণ্য হবে। একটি অবৈধ অস্ত্র, আরেকটি সরকারি নিষিদ্ধ অস্ত্র আপনাদের হাতে। আন্তর্জাতিক আদালতেও মামলা যেতে পারে। এ অস্ত্র তারা কোথায় পেলো।’

টিটি/এএসএ/জিকেএস