শরীরে প্রায় তিন শতাধিক গুলির স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মো. রাশেদুল করিম ওরফে রাফাত (২৮)। স্বপ্ন ছিল বন্যপ্রাণি নিয়ে কাজ করার। কিন্তু এখন বৃদ্ধ বাবা-মার বোঝা হয়ে গুলির যন্ত্রণা নিয়ে কাটছে দিন।
Advertisement
মো. রাশেদুল করিম ওরফে রাফাত রাজবাড়ী পৌরসভার কাজীকান্দা এলাকার মো. সামছুউদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে। ২০২২ সালে আসহানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করেছেন। ঢাকার গোলাপবাগে বড় বোনের বাসায় থাকতেন তিনি।
গত ১৮ জুলাই রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাসার বাজার করতে বের হয়ে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর সংঘর্ষের মাঝে পড়ে পিঠ ও হাতে গুলিবিদ্ধ হন রাফাত। এ সময় তার হাত ও পিঠে প্রায় ৪ শতাধিক ছররা গুলি লাগে। গুলিগুলো খুব কাছ থেকে করায় চামড়া ভেদ করে মাংসপেশীর ভেতরে ঢুকে যায়। পাশাপাশি তার বাম হাতের কব্জি ভেঙে যাওয়াসহ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন।
আরও পড়ুন
Advertisement
পরে কয়েকজন তাকে ধরাধরি করে প্রথমে শনিরআখড়ার সালমান হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু সেখনে দায়িত্বরতরা ভর্তি না নেওয়ার নির্দেশনা আছে জানিয়ে ব্যান্ডেজ ও একটি ইনজেকশন দিয়ে ছেড়ে দিলে পালস স্পেশালাইজড হাসপাতালে যান। কিন্তু সেখানেও ভর্তি নেন না কর্তব্যরতরা। সে সময় তার ডাক্তার ভাইয়ের অনুরোধে তারা তার পিঠ ও হাত থেকে কিছু স্প্লিন্টার বের করে স্যালাইন দিয়ে ছেড়ে দেয়। এমনকি ডেলটা হাসপাতালে গেলেও ভর্তি নেয়নি। শেষমেশ তার ভাই রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট অর্থোপেডিক সার্জারি ডা. এজেডএম রেজাউল করিম রাজবাড়ী থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তাকে রাজবাড়ীতে এনে ৭৯টি স্প্লিন্টার বের করে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এখনও তার হাত ও পিঠে প্রায় ৩ শতাধিক স্প্লিন্টার রয়ে গেছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজবাড়ীতে বড় ধরনের হতাহতের তেমন কোনো ঘটনা না ঘটলেও ঢাকা ও সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজবাড়ীর দুই শিক্ষার্থীসহ ৪ জন নিহত ও বেশ ককেজন আহত হয়েছেন। আহতদের একজন রাফাত।
আরও পড়ুন
ধারের টাকায় চিকিৎসা চলছে গুলিবিদ্ধ রায়হানেররাফাতের বাবা ও মা বলেন, কোনো বাবা-মা চায় না তার ছেলে অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকুক। এখন চাকরি করে রাফাতের জীবন গড়ার সময়। আর এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে সে বিছানায় পড়ে আছে। এ অবস্থায় ওর ভবিষ্যৎ কী হবে ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছি না। নিজে নিজে সে কিছুই করতে পারে না। দেশের যে অবস্থা ছিল তাতে বড় ছেলে ডাক্তার না হলে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতো রাফাত। তাদের ছেলের মতো দেশে অসংখ্য সন্তান এ অবস্থায় রয়েছে। সবার চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ তাদের ভবিষ্যৎ যেন সরকার দেখে।
Advertisement
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী সাঈদুর জামান সাকিব বলেন, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাজবাড়ীর কতজন নিহত বা আহত হয়েছেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে এখন পর্যন্ত যে তথ্য আছে সে অনুযায়ী ঢাকায় দুই শিক্ষার্থীসহ রাজবাড়ীর ৪ জন শহীদ ও একজন গুরুতর আহতের খবর আছে। এছাড়া রাজবাড়ীতেও বেশ কয়েকজন আহত আছে। সম্পূর্ণ তালিকার কাজ চলছে। এই আন্দোলনে নিহত বা আহতের পরিবারকে সরকারিভাবে সহযোগিতার পাশাপাশি দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
গুলিবিদ্ধ মো. রাশেদুল করিম ওরফে রাফাত বলেন, বাসার বাজার করতে গিয়ে আন্দোলনকারী ও আইন শৃঙ্খলারক্ষকারীর মাঝে পড়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। খুব কাছ থেকে তার হাত ও পিঠে গুলি করা হয়। এ ঘটনার পর ঢাকার ৩টি হাসপাতালে গেলে কেউ ভর্তি নেয়নি। শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে। সব হাসপাতাল থেকে বলেছে এসব রোগী ভর্তি নেওয়া নিষেধ আছে।
তিনি আরও বলেন, ওই রাতেই রাজবাড়ীতে নিয়ে এসে তার বড় ভাই নিজের অধীনে রেখে কিছু গুলি বের করে যথাযথ চিকিৎসা দিয়েছেন। যার কারণে একটু সুস্থ হয়েছেন। তবে এখনো তার শরীরে প্রায় ৩ শতাধিক স্প্লিন্টার আছে। বাড়িতেই তার চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এখন তিনি পরিবারসহ বৃদ্ধ বাবা-মায়ের বোঝা হয়ে গেছেন। কারণ নিজে নিজে তেমন কিছুই করতে পারেন না। কোনো রকম শুয়ে বসে দিন কাটে।
আরও পড়ুন
আমাদের কলিজার ওপর দিয়ে গাড়ি গেছে, কঠিন বিচার চাইতিনি বলেন, ইচ্ছা ছিলো পড়াশুনা শেষ করে বন্যপ্রাণি নিয়ে কাজ করা। কিন্তু এখন স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি। এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
রাফাতের বড়ভাই রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট অর্থোপেডিক সার্জারি ডা. এজেডএম রেজাউল করিম বলেন, প্রথমে রাফাতের অবস্থা ভালো ছিল না। অনেক রক্ষ ঝরছিল। রাজবাড়ীতে আনার পর অজ্ঞান করে গুলি বের করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গুলিগুলো চামড়া ভেদ করে মাসেল লেভেলে ঢুকে যাওয়ায় অল্প কিছু গুলি বের করতে পারলেও বাকিগুলো বের করতে পারেননি। এ অবস্থায় ওই গুলিগুলো বের করতে গেলে আরও বেশি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তার হাত ও পিঠের অবস্থা একই। এ অবস্থায় ভালো হতে কতদিন সময় লাগবে তা বলা মুসকিল। তার এক্স-রে ফ্লিম দেখে মনে হচ্ছে তার হাত ও পিঠে এখনও তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো গুলি রয়ে গেছে।
এফএ/এমএস