সাহিত্য

গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৩

গোমতীর শূন্যস্রোতযাত্রাদল রূপের লাগি আঁখি ঝরে, গুণে মন ভরেপ্রতি অঙ্গের লাগি মন মোর নিংড়ে

Advertisement

ঠাকুরদা যখন তার নাতনিকে গল্প বলে চলেছেন, ঠিক সেই সময়ই ময়নামতি রাজবাড়িতে এসে উপস্থিত হলো যাত্রাপালার শিল্পীরা। অলিন্দের ভেতর কালো ছায়া স্তম্ভিত হয়ে আছে। এমন নয় যে, আলো নেই। অলিন্দের ছাদ থেকে স্থানে স্থানে ধাতব জিঞ্জির নেমে এসে প্রদীপাধার ধারণ করে আছে; কিন্তু এসব প্রদীপের আলোক অন্ধকারকে দূরীভূত না করে যেন ঘনীভূত করে চলেছে। এই তমসানিগূঢ় অলিন্দ বেয়ে হেঁটে চলেছে যাত্রাপালার শিল্পীরা। অতঃপর অলিন্দ থেকে সোপান ভেঙে নেমে এলো ওরা। এমন সময় সহসা তীব্র হাওয়া উঠলো। প্রবল বাত্যাঘাতে কেঁপে উঠলো প্রদীপসমূহের বিশীর্ণ শিখা। শিল্পীদের বস্ত্রের প্রান্তদেশ এই বাতাসে প্রকম্পিত হলো, উড়ে পড়লো তাদের উত্তরীয়। তবুও ওরা ভ্রূক্ষেপ করলো না। তাদের কেশপাশ নিদারুণ প্রভঞ্জনে উড়ছে। সোপাননিম্নে মহার্ঘ বিলাসকক্ষ। স্থানে স্থানে প্রদীপ জ্বলছে। কোমল গালিচায় গুণীমানী লোকজন আসন পেতেছেন। এই বিলাসকক্ষ এই সন্ধ্যায় জেগে উঠেছে বর্ণে, বিভঙ্গে। গুণীমানী লোকজন আজ যাত্রাপালা উপভোগ করবেন। তার আগে তারা নর্তকিদের নৃত্যগীত উপভোগ করছেন। এই বিলাসকক্ষে পৌঁছে দলপ্রধান অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কক্ষটির এক পার্শ্বে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। এক ধারে কিছু নর্তকি নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে তারা কিছুক্ষণ আগেই তাদের নৃত্যগীত পরিবেশন করেছে; কেননা, যদিও তাদের অঙ্গে নৃত্যগীতের পোশাক, তবুও কারও বসন বিগলিত, কারও শিঞ্জিনী স্খলিত, কারও কিঙ্কিণী পদবন্ধ থেকে বিচ্যুত। তাদের উত্তুঙ্গ স্তনযুগল—দুটি মাংসগ্রন্থি ব্যতীত আর কিছুই নয়, আলোড়িত অতিকায় সুবিপুল মসৃণ জঘন। নর্তকিদের ওপর দলপ্রধানের দৃষ্টি নীল রাত্রির মতো আয়ত, স্থির।

হঠাৎ যাত্রাপালা শুরু হওয়ার ঘণ্টাটি বেজে উঠলো। প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যে, নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও, দলপ্রধান নর্তকিদের দিক থেকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ঘণ্টাটি যখন থামল; তখনই সে গুণীমানী লোকজনের সামনে এসে দাঁড়াল। অতঃপর ঘোষণা করলো: আজকের এই আসরে সমবেত সুধীজন, অন্তঃস্থিত প্রণতি জানাই সর্বচরণে। আমরা গোমতী অঞ্চলের একটি যাত্রাদল। যাত্রাপালার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি অনেকদিন। যাত্রাজালে বেঁধে আছি বহুদিন। হে হৃদয়জন, শ্রীস্বজন সৃজনে মোরা স্বাগত জানাই সকলকে। এবারের আমাদের পরিবেশনা: কতরং। যেকথার গতি অচেনা, অতল যার শেষ ঠিকানা। আমরা খুঁজছি জীবন, দেখছি সংগ্রাম, করছি কাজ। উপলব্ধি করি: কেন করব যাত্রাপালা? কেনই-বা করছি? কেনই-বা বেঁচে আছি! কোন্ কর্ম, কোন্ বিপ্লবী জীবনগাথা রচনা করার জন্য প্রত্যহ ভোর নতুন করে সৃষ্টি হয়। আমরা সামান্য এক যাত্রদল। হে প্রভুগণ, আপনারা গুণীমানী লোকজন, আপনারা কত পড়েছেন, কত শুনেছেন, আপনারা রসের বিচার করতে জানেন। আমরা আপনাদের সভায় এসেছি, যদি অনুমতি পাই আপনাদের আজ, তাহলে নারী ও পুরুষের প্রণয়বয়ান শোনাব। ভালোবাসার জন্যই মানুষ এই মর্ত্যলোকে জন্মেছে, কিন্তু এই-যে নর-নারী যাদের প্রণয়বয়ান আমরা শোনাব তাদের মতো এমন ভীষণ মধুরভাবে কেউ বোধহয় কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারেনি। আপনারা মহৎ, আপনারা উদার, আপনারা জানেন ভালোবাসা হচ্ছে অগ্নিসম, যেখানে কোনো পাপ প্রবেশ করতে পারে না। আপনারা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবেন, আমাদের প্রণয়বয়ানের প্রেমিক ও প্রেমিকারা প্রেমশক্তিতে কী করে পাপ-পুণ্য ছাড়িয়ে যায়। আহা, তাদের প্রণয়বয়ান শুনলে যে-মানুষ পাহাড়ের মতো কঠিন তারও বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে প্রেমঝরনাধারা। অপ্রেমিকও প্রেমিক হয়ে উঠবে। সুখভোগ আমোদ-আহ্লাদে ডুবে আছে যেজন, সেও এই প্রণয়বয়ান শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াবে, তারও মনে পড়বে: জীবনে কী যেন বাকি রয়ে গেছে, বুকের মধ্যটা উদাস উদাস হয়ে আছে। এই প্রণয়বয়ান শোনার পর, যখন আপনারা কেউ নির্জনে সময় কাটাবেন, তখন আপনাদের মনে হবে: এই মর্ত্যলোকে যে জন্মালাম, জীবনটা কি ঠিকমতো কাটানো হলো? নাকি একজীবন মনের ভুলেই কেটে গেলো! ভালোবাসাহীন জীবনই তো ভুল জীবন! আমরা এই প্রণয়বয়ান গ্রামে-গঞ্জে-হাটে-বাজারে, নদীর ধারে পরিবেশন করে বেড়াই। আজ এসেছি আপনাদের সভায়। অনুমতি যদি দেন তাহলে শুরু করি প্রণয়বয়ান: কতরং।

দর্শকের সারি থেকে একজন বলল: অনুমতি দেওয়া হলো। প্রণয়বয়ানটি এখন শুরু করুন।

Advertisement

দলপ্রধান বলল, আমাদের প্রণয়বয়ানে নায়িকা দুইজন: চন্দ্রা ও সুশীলা; নায়কও দুইজন: সুকান্ত ও পার্থ। কোথায়, কত দূরে ওরা ছিল তবুও তাদের দেখা হয়ে গেলো। পৃথিবীতে তাদের চেয়ে সুন্দর, তাদের চেয়ে নিষ্পাপ নর-নারী কি আর জন্মেছে? তাদের মতো সুখী কেউ নেই, তাদের মতো দুঃখীও কেউ নেই। ভালোবাসা মানে কি দুঃখ? হয়তো-বা তাই, তবুও মানুষ ভালোবাসার জন্য ছুটে বেড়ায় দিগদিগন্ত, স্বইচ্ছায় প্রেমনদীতে ঝাঁপ দেয়। আমাদের নায়ক ও নায়িকারা ঠিক তেমনই প্রেমনদীতে ঝাঁপ দিলো। তীব্র সুরার মতো প্রেম মিশে যায় প্রেমিক-প্রেমিকার শোণিতে, তখন তাদের নেশাগ্রস্তের মতোই দেখায়। প্রভুগণ, সে কী আনন্দ, সে কী উৎসব, সে কী প্রাচুর্য—এসবের বর্ণনা দিয়ে আপনাদের মূলবান সময় নষ্ট করতে চাই না, বরং একটা কথা না বললেই নয়, তাই বলছি: দিন যায়, রাত যায়, চলে তাদের প্রণয়। মাঝেমধ্যে তারা গোমতী নদীর দিকে তাকায়। খায়, ঘুমোয়, বেঁচে থাকে নিজেদের মতো। মাঝেমধ্যে চলে মানাভিমান। প্রভুগণ, আপনারা জানেন, বিশ্বসংসারে সুখ বড় চঞ্চল। তাই হয়তো-বা হঠাৎ তাদের জীবনাকাশে ঝড় উঠলো। ভীষণ ঝড়। তার ধাক্কায় জীবন হয়ে ওঠে ভীষণ জটিল। প্রভুগণ, আপনারা জ্ঞানীগুণীজন, আপনাদের কিছুই অজানা থাকার কথা নয়। আপনারা জানেন, যে পাপ করে সে শাস্তি এড়িয়ে গেলেও ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করেন না। আসলে, ভালোবাসা পাপ নয়, যদি হতো তাহলে পৃথিবীতে পুণ্য বলে কিছুই থাকতো না। ভালোবাসা যদি পাপ হয়, তাহলে গীতও পাপ, পুজো করাও পাপ। কথায় আছে না: প্রেমের মরা জলে ডোবে না! প্রভুগণ, আপনারা স্বীকার করবেন যে, যারা ভালোবাসাকে জেনেছে তাদের কাছে দুগ্ধফেননিভশয্যা আর তৃণশয্যার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাদের কাছে বনের কণ্টকও মনে হয় পুষ্পকুসুম। প্রখর সূর্যকেও মনে হয় চাঁদের মতো সুশীতল। প্রভুগণ আর বেশি কথা নয়, আসল কথায় আসা যাক্। শুনুন, কতরং প্রণয়বয়ানটির জটিল অংশগুলো।

একটি ক্রুদ্ধ আহ্বান-গর্জনের মতো অবিরাম অনন্ত তার শব্দ; উৎক্ষিপ্ত চূর্ণ জলের প্রতিটি কণায় ইন্দ্রধনুর সব রং ফুটে উঠে ভেঙে পড়ছে। পেছন থেকে কারা যেন তাকে গহ্বরের দিকে ঠেলতে লাগল—নিষ্পলক চক্ষু তার চঞ্চলভাবে জনতার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু যেন গৃহ ছাপিয়ে প্রদীপের প্রতিবিম্ব তার অন্তরে সজীব হয়ে উঠে আকর্ষণ করছে; কেবলই বলছে: শোনো! শোনো! কতরঙের কাহিনি।

জনতার গুঞ্জন শুনতে শুনতে কী মনে করে হঠাৎ পেছন ফিরে দলপ্রধান যেন থমকে প্রদীপের প্রতিবিম্বের মধ্যে দিক্ভ্রান্ত হয়ে গেল—তার শীতল রক্ত দেখতে দেখতে জরাক্রান্তের নাড়ির মতো উদ্দাম হয়ে উঠলো। তখনই একটি দোঁহা গাইতে লাগল যাত্রাদলের শিল্পীরা:

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোরপ্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দেপরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে।সই, কি আর বলিব যে পণ কর্যাছি মনে সেই সে করিব। রূপ দেখি হিয়ার আরতি নাহি টুটেবল কি বলিতে পারি যত মনে উঠে।দেখিতে যে সংখ উঠে কি বলিব তাদরশ পরশ লাগি আউলাইছে গা।হাসিতে খসিয়া পড়ে কত মধুধারলহু লহু, হাসে পঁহু পিরীতির সার।গরু গরবিত মাঝে রহি সখীসঙ্গেপুলকে পুরয়ে তন, শ্যাম পরসঙ্গে।পুলক ঢাকিতে করি কত পরকারনয়নের ধারা মোর বহে অনিবার।ঘরের যতেক সবে করে কানাকানিজ্ঞান কহে লাজ-ঘরে ভেজাই আগুনি।

Advertisement

চলবে...

আগের পর্ব পড়ুন

গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০১ গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০২

এসইউ/এমএস