দেশজুড়ে

আমাদের কলিজার ওপর দিয়ে গাড়ি গেছে, কঠিন বিচার চাই

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর রাজধানীর বাড্ডায় খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন শেরপুরের মাহবুব আলম। কিন্তু সারাদেশে যখন আন্দোলন তুঙ্গে কিছুতেই তার ঢাকায় মন বসছিল না। ছুটে যান গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন আন্দোলনে। যোগ দেন শেখ হাসিনার সরকার পতনের অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচিতে।

Advertisement

শেরপুর সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন মাহবুব আলম। আইসিটি ডিভিশনের জেলার হার্ডপাওয়ার প্রজেক্টের কো-অর্ডিনেটর হিসেবেও কাজ করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন রোববার (৪ আগস্ট) শেরপুরে পাঁচ শিক্ষার্থী নিহত হন। তাদের মধ্যে মাহবুবসহ তিনজন নিহত হন গাড়িচাপায়, দুইজন নিহত হন গুলিবিদ্ধ হয়ে। নিহত অন্যরা হলেন আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তুষার (২৪), শারদুল আশিস সৌরভ (২২), সবুজ হাসান (২০) ও মিম আক্তার (১৮)।

মাহবুবের স্মৃতিচারণ করে তার খালা জাগো নিউজের কাছে তুলে ধরেন সেদিনের সেই ঘটনার কথা।

‘স্বৈরাচারী সরকার গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ করে দিছিলো, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিছিলো। আমি আমার কলিজার টুকরোটাকে একটু শেষ দেখাও দেখতে পারি নাই। সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে ডিরেক্ট গুলির অর্ডার কেমন করে দিলো হাসিনা? কেমনে গুলি করছে এসব আমরা দেখছি। আমরা কাউকে বুঝাইতে পারতাছি না।’-নিহত মাহবুবের খালা

Advertisement

মাহবুবের খালা বলেন, “ছেলেটা আমার কাছেই ছিল। কোটা আন্দোলনের কারণে ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হলে ২৩ জুলাই সে বাড়িতে চলে যায়। যাওয়ার সময় আমি বললাম, বাবা দেশের পরিস্থিতি ভালো না, তুই এখানেই আরও দুয়েকদিন থেকে যা। তখন সে বললো, ‘না খালা, আমি থাকবো না। আমার কম্পিউটার ক্লাসে অনেক স্টুডেন্ট আছে, তাদেরকে আমার সব বুঝিয়ে দিতে হবে। আমি সব বুঝিয়ে দিয়ে আবার আসবো।’ আমি ছাদে পুঁইশাক লাগাইছি, তুই খাবি বলার পরে সে বলে, ‘আরেকটু বড় হোক আমি এসে খাবো’।”

আরও পড়ুন:

শেরপুরে গাড়িচাপা ও গুলিতে পাঁচ শিক্ষার্থী নিহত ছাত্র আন্দোলন দমনের নির্দেশ শেখ হাসিনার, গুলির নির্দেশ কামালের মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচার হতে পারে

খালা বলেন, ‘যাওয়ার পরেও আমি প্রতিদিন খোঁজ নিতাম। এমনকি যেদিন সে মারা যায় সেদিনও সকালে কল দিয়ে শুনলাম, পাশের ঘরেই শুয়ে আছে, ভালো আছে। মাত্র খাওয়া-দাওয়া করলো। আমি বললাম, বাইরের পরিস্থিতি খারাপ, যাতে বাসা থেকে বের না হয়। ওইদিনই বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শুনি মাহবুবকে মেরে ফেলেছে। আমার এক ভাতিজা আমারে ফোন দিয়ে জানায়। সে দাঁড়িয়েছিল, ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি একদম ওর বুকের ওপর দিয়ে উঠায় দিছে। ওইখানেই মারা গেছে সে। তার সঙ্গে আরও দুইটা ছেলে, একটা মেয়েও ছিল। তাদের কোনো খোঁজ-খবর জানতে পারি নাই। মারা যাওয়ার পরেও লাশ দিতে চায় নাই, পরে ছাত্ররা জোর করে লাশ নিছে। পরের দিন দুপুরে তাকে দাফন করা হয়।’

মাহবুবের খালা আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বৈরাচারী সরকার গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ করে দিছিলো, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিছিলো। আমি আমার কলিজার টুকরোটাকে একটু শেষ দেখাও দেখতে পারি নাই। সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে ডিরেক্ট গুলির অর্ডার কেমন করে দিলো হাসিনা? কেমনে গুলি করছে এসব আমরা দেখছি। আমরা কাউকে বুঝাইতে পারতাছি না। ষোল-সতেরো বছরের ছেলেগুলোকে কীভাবে মেরে ফেলা হলো। এই ছেলেগুলো মা-বাবারে কী দিয়ে বুঝ দেওয়া যায়। আমরা একটা ছেলেকে তিল তিল করে মানুষ করি, নিজে না খেয়ে ওদের খাওয়াই। শেখ হাসিনা এই ফুলের মতো নিষ্পাপ ছেলেগুলোকে মেরে ফেললো। মাহবুব নিরপরাধ একটা বাচ্চা ছেলে।’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘আজকে আমাদের নিষ্পাপ সন্তানদের হারাতে হচ্ছে। একবার ভাবেন, এই মাহবুবের স্বপ্নটা কত বড় ছিল। সে বড় হয়ে সফল উদ্যেক্তা হতো। আমরা আর এরকম স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া দেখতে চাই না। আমরা আর দুর্নীতি-অবিচার দেখতে চাই না।’

‘আমাদের কলিজার ওপর দিয়ে গাড়ি গেছে। যেই ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি গেছে আমরা তার কঠিন বিচার চাই। আমার বোনের পোলারে এরকম করে গাড়িটা বুকের ওপর চাপা দিয়ে কেন মারলো? কী অপরাধ ছিল? নিরপরাধ, নির্দোষ ছেলেটাকে যে মেরে ফেললো তার বিচার চাই, আপনাদের কাছে আর কিছুই বলার নাই আমার।’- নিহত মাহবুবের খালা

মাহবুব হত্যার বিচার দাবি করে তার খালা বলেন, ‘আমাদের কলিজার ওপর দিয়ে গাড়ি গেছে। যেই ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি গেছে আমরা তার কঠিন বিচার চাই। আমার বোনের পোলারে এরকম করে গাড়িটা বুকের ওপর চাপা দিয়ে কেন মারলো? কী অপরাধ ছিল? নিরপরাধ, নির্দোষ ছেলেটাকে যে মেরে ফেললো তার বিচার চাই, আপনাদের কাছে আর কিছুই বলার নাই আমার।’

আরও পড়ুন:

বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৬৫০ ফুসফুসে ক্ষত, হাসপাতালে ধুঁকছেন আহতরা

কী ঘটেছিল সেদিন?

রোববার ৪ আগস্ট বিকেল ৩টা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা শেরপুর জেলা শহরের খোয়ারপাড়, শেরপুর সরকারি কলেজ গেট ও খড়মপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেন। একপর্যায়ে খড়মপুর এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। পরে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের টহল গাড়ি দ্রুত চলে আসে। এসময় আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে দ্রুতবেগে একটি গাড়ি কয়েকজনকে চাপা দিয়ে চলে যায়। গুরুতর আহত কয়েকজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে মারা যান মাহবুবসহ তিনজন। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মিম আক্তার ও সবুজ।

শিক্ষার্থী হত্যায় মামলা, আসামি যারা

শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গাড়িচাপা দিয়ে ও গুলি করে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। গত ১২ আগস্ট নিহতদের স্বজনরা বাদী হয়ে সদর থানায় মামলা করেন। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী সবুজ হত্যা মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শেরপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ছানুয়ার হোসেন ছানু, শেরপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর রুমানসহ আরও ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও ৩০০/৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া গাড়িচাপায় শিক্ষার্থী মাহবুব নিহতের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৩০০/৪০০ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা হয়েছে। শিক্ষার্থী সবুজ হত্যা মামলার বাদী হয়েছেন তার ভাই মো. সাদ্দাম হোসেন। আর মাহবুব ও সৌরভ হত্যা মামলার বাদী হয়েছেন মাহবুবের মা মাহফুজা খাতুন। তবে এসব মামলায় এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি।

এমএইচএ/এসএনআর/এমএমএআর/এমএস