ছাত্র-জনতার বিজয়ের উৎসব দেখতে পারছেন না ১৬ বছর বয়সী হিমেল মিয়া। নতুন উদ্যমে দেশ গড়ার নানা কাজে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কেউ করছেন রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, কেউ কেউ দেওয়ালে আঁকছেন নতুন বাংলাদেশের গ্রাফিতি। কেউ বা অংশ নিচ্ছেন নিজ শহর পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে। অথচ এ আন্দোলনের অংশ হয়েও নতুন বাংলাদেশ ও বিজয়ের উৎসব দেখা হচ্ছে না পুলিশের ছররা গুলিতে চোখ হারানো টাঙ্গাইলের হিমেল মিয়ার। সহপাঠীরা যখন বিজয় উৎসবে মাতোয়ারা, তখন চোখে অনন্ত অন্ধকার নিয়ে হিমেল কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে।
Advertisement
তিনি বলেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়া চার সহপাঠীকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তাদের ছাড়িয়ে নিতে হাইওয়ে থানায় যাই। এসময় পুলিশ ছররা গুলি মারে। এতে চোখ, মুখ ও মাথায় আঘাত পাই। শেষপর্যন্ত আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। গণতন্ত্রের বিজয় আসে। তবে আমি নিজেই এখন অন্ধকারে। শিক্ষার্থীদের সাজানো বাংলাদেশের বিজয় উৎসব দেখতে পারছি না।
হিমেল উপজেলার গোড়াই উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতেন। দুই বছর আগে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্থানীয় একটি সাউন্ড সিস্টেমের দোকানে কাজ শুরু করেন। ৪ আগস্ট বিকেলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থান নেন হিমেল। সেখানে পুলিশ টিয়ারসেল ও ছররা গুলি ছুড়ে। এতে অর্ধশতাধিক আহত হন।
হিমেলের চিকিৎসা চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সেখানে ১৭ নম্বর বেডে ভর্তি তিনি। তার মাথা ও পুরো মুখে গুলির ক্ষত। দুই চোখেও রয়েছে গুলির চিহ্ন। চারটি দাঁত ভেঙে যাওয়ায় স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারছেন না। মাঝে মধ্যে শুধু মাকে ডাকছেন। কিন্তু ডাকবে যে ঠোঁটে, তাতেও লেগেছে গুলি। দিতে হয়েছে ছয়টি সেলাই।
Advertisement
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শতাধিক ছররা গুলি লেগেছে হিমেলের মাথা ও মুখে। তার চোখে স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি আর ফিরবে না। এখনো কয়েকটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। কবে সুস্থ হবে তা নিশ্চিত নয়।
হিমেলের বড় ভাই জনি মিয়া বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কুমুদিনী, টাঙ্গাইল সদর হাসপাতাল, ঢাকার চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল হাসপাতাল, সবশেষ ঢামেকে ভাইয়ের চিকিৎসা চলছে। চোখের গুলি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করা হয়েছে। তবে মুখ ও মাথার গুলি এখনো বের করা হয়নি। এভাবে কতদিন চলবে জানি না।
জনি মিয়া ঢাকার উত্তরায় একটি স্পিনিং মিল কারখানায় চাকরি করেন। আট হাজার টাকা বেতন পান। এই স্বল্প আয়ে তাদের পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে। এরমধ্যে আবার ভাইয়ের চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। সব টাকা ধার করে নেওয়া। ফলে তাদের সংসারে নেমে এসেছে অন্ধকার।
হিমেলের মা নাসিমা আক্তার দুঃখ করে বলেন, ছেলের চোখ আর ভালো হবে না। সে আর পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না। তবে সুস্থ হতে যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন তা আমরা খরচ করতে পারছি না। আমার সন্তানের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে সরকার ব্যবস্থা নেবে এটাই প্রত্যাশা।
Advertisement
হিমেল বলেন, নতুন সরকারের কাছে একটাই দাবি, আমার চোখের আলো ফেরাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমার চলার মতো একটা ব্যবস্থা করবে।
শুধু হিমেল নয়, তার মতো কলেজছাত্র ইমন মিয়াও (১৮) ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টাঙ্গাইলের সমন্বয়ক নবাব আলীর ভাতিজা ও গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের নলিন এলাকার জুলহাসের ছেলে। ২০২৩ সালে মনিরুজ্জামান খান বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাবস্থায় ইমনের ভ্যানচালক বাবা মারা যান। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় ছাত্র বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে সংসারের খরচ মেটাতেন। ছোট তিন ভাই-বোনকেও লেখাপড়ার খরচ দিতে হতো। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিই হাসপাতালের আইসিইউতে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না তার পরিবার।
ইমনের মা রিনা বেগম কান্না করতে করতে সাংবাদিকদের বলেন, বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেছিল ইমন। ডাক্তার বলেছে, জ্ঞান ফিরলে পেটে অপারেশন করা লাগবে। এতে অনেক টাকার প্রয়োজন।
কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকু তাদের দেখতে ঢামেক হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেন বলে জানা গেছে।
এস এম এরশাদ/জেডএইচ/জিকেএস