• নির্মাণ হলে এটি হবে দেশের সর্ববৃহৎ পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি• ঝুলে আছে এক হাজার একর জায়গা অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত
Advertisement
অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এগোতে পারছে না দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অযাচিত হস্তক্ষেপে বিপিসির প্রায় সব প্রকল্পে ধীরগতি। এসব নিয়ে জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের করা ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও ৯ বছর ঝুলে আছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ৭৫ লাখ টন সক্ষমতার পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি স্থাপনের পরিকল্পনা। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির জন্য স্প্যানিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত করেও চার বছরে মেলেনি মন্ত্রণালয়ের সম্মতি। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন খোদ বিপিসির সংশ্লিষ্ট পরিচালক। বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কেউ মুখও খুলছেন না।
জানা যায়, ইস্টার্ন রিফাইনারি বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি। ১৯৬৬ সালে নগরীর গুপ্তখাল এলাকায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৮ সালের ৭ মে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে কোম্পানিটি। ইস্টার্ন রিফাইনারির এ ইউনিটটির সক্ষমতা ১৫ লাখ মেট্রিক টন। এই রিফাইনারি থেকে দেশের মোট চাহিদার ২৫ শতাংশ জ্বালানি চাহিদা পূরণ করা হয়। জ্বালানি সক্ষমতা ও নিরাপত্তা বাড়াতে ইস্টার্ন রিফাইনারির বর্তমান স্থাপনার পাশেই ৩০ লাখ মেট্রিক টন সক্ষমতার আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল বিপিসির। এরই মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে করার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবে ওই প্রকল্পটিও কখন বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি।
Advertisement
৭৫ লাখ টন সক্ষমতার রিফাইনারি নির্মাণের পরিকল্পনার বিষয়টি আমার জানা নেই। এগুলো আমাদের (বিপিসি) পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।- বিপিসির পরিচালক অনুপম বড়ুয়া জাগো
সময়ের সঙ্গে দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে জ্বালানির চাহিদাও বাড়ছে। ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিশোধিত জ্বালানি রপ্তানির লক্ষ্যে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃহৎ আকারে সমন্বিত তেল শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা নেয় বিপিসি। পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এলাকায় পরিকল্পনা নেওয়া হয় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধন ক্ষমতার রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার। পাশাপাশি দুই লাখ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি এলপিজি ইমপোর্ট, স্টোরেজ ও বটলিং প্ল্যান্ট এবং অয়েল রিজার্ভার ইনস্টলেশন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় বিপিসি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য এক হাজার একর জায়গা অধিগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় বিপিসি পর্ষদ।
আরও পড়ুন জং ধরছে পদ্মা-মেঘনার নির্মাণাধীন ভবনে, ব্যয় বেড়ে তিনগুণ ৪৭ বছর ধরে ‘পরের ঘরে’ বিপিসি এস আলম চায় ন্যূনতম ৫১ শতাংশ, বিপিসি ৬০বিপিসি সূত্রে জানা যায়, পায়রা বন্দরের নিকটবর্তী স্থানে রিফাইনারি, এলজিপি বটলিং প্ল্যান্ট, অয়েল রিজার্ভারসহ একটি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং স্থাপনের জন্য এক হাজার একর জায়গা বিপিসির অনুকূলে ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে চিঠি দেয় বিপিসি। তারাই ধারাবাহিকতায় পরের ১২ আগস্ট বিপিসির প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত জমি বরাদ্দের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
২০১৬ সালের ৩ মে একই বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং পটুয়াখালী জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট বিপিসির প্রতিনিধিদল প্রকল্প স্থান পরিদর্শন করেন। ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটির অন্য তিন সদস্য পায়রা বন্দর এলাকায় সম্ভাব্য অয়েল রিফাইনারি প্রকল্পের স্থান পরিদর্শন করেন।
Advertisement
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, পায়রায় রিফাইনারি নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে (ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি) পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। এতে অভিপ্রায় প্রকাশ করে ১৭টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে যোগ্য বিবেচিত করে বিপিসি। এর মধ্যে বিপিসির কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নে স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠান ‘টেকনিকাস রিউনিদাস- স্পেন’ সর্বোচ্চ স্কোর পায়। পরে প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) দেওয়ার বিষয়টি ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর বিপিসি বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়। ওই সময়ে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির জন্য প্রতিষ্ঠানটি ইউরো এবং ইউএস ডলার মিলে বাংলাদেশি টাকায় ১৮ কোটি ১৮ লাখ টাকার (প্রতি ইউরো ৯২ টাকা ৯৭ পয়সা এবং প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৩৩ পয়সা হিসেবে) দর প্রস্তাব করে। এতে ভ্যাট, অগ্রিম আয়করসহ ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির ব্যয় নির্ধারিত হয় ২৪ কোটি ৫৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির কার্যাদেশের প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিপিসি। ওই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীসময়ে দেশের জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা, এলএনজি আসার কারণে রিফাইন্ড অয়েলের চাহিদা কমার আশঙ্কা আছে কি না এবং আরও কিছু তথ্য চেয়ে ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিপিসিকে চিঠি দেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। ২০২০ সালের ১৯ মার্চ এসব তথ্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে পাঠায় বিপিসি।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) অনুপম বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘৭৫ লাখ টন সক্ষমতার রিফাইনারি নির্মাণের পরিকল্পনার বিষয়টি আমার জানা নেই। এগুলো আমাদের (বিপিসি) পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।’
পরে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পায়রায় ৭৫ লাখ টনের রিফাইনারি এবং দুই লাখ মেট্রিক টনের এলপিজি স্টোরেজ ও বোটলিং প্ল্যান্ট করার বিষয়ে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করার জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। একটি স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়নও দেওয়া হয়। স্প্যানিশ ওই প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদনের জন্য ২০২০ সালের মার্চে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এরপর কোভিড পরিস্থিতি শুরু হয়। পরবর্তীসময়ে আর কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় প্রকল্পটির বিষয়ে এগোনো যায়নি।’ ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে দুই চেয়ারম্যান, তিন পরিচালক ও সচিব বদলি হয়ে চলে যান। এখন নতুন চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা যোগ দিয়েছেন। তারা বিষয়টি ওয়াকিবহাল হলে হয়তো নতুন করে আবার এগোনো যাবে।’
এমডিআইএইচ/এএসএ/জিকেএস