সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তুমুল গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে দেশ ছাড়েন। তার এই দেশ ছাড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। গণতন্ত্র, বৈষম্যের অবসান ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা এরপর দেশে শক্তিশালী হবে, না দুর্বল হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
Advertisement
ছাত্র জনতার এই আন্দোলনে যে স্লোগানের উদ্ভব হয়েছে তা হচ্ছে ‘বৈষম্য’ মানি না। কিসের বৈষম্য? এর ব্যাখ্যা বুঝতে না পারলে কিন্তু বৈষম্য ধারণাটি মূর্ত হয় না। আমরা জানি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈষম্য হচ্ছে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য। সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নানা ধরনের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের বৈষম্য। এছাড়া জেন্ডার বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য, শ্রেণীগত বৈষম্য এগুলো হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের সমাজে বিদ্যমান এবং মানবজাতির সর্বজনীন লক্ষ্যই হচ্ছে সভ্যতার অগ্রযাত্রার মাধ্যমে তা ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা। কিন্তু সেই কাজটিতে আমরা এগুতে পারিনি।
আমাদের নতুন প্রজন্ম নিজের অভিজ্ঞতায় জেনেছে, রাজনীতির অপব্যবহার রাজনীতিকে কীভাবে নিছক ক্ষমতা ও বিত্তের বিনিয়োগে পরিণত করেছে। তাই তারা ওয়েবসাইট তৈরি করে ইস্যুভিত্তিক এবং রাজনৈতিক মতামত নির্বিশেষে একটি ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম গড়ে তোলেন। সেই অরাজনৈতিক নানা বর্ণের প্লাটফর্ম আন্দোলনই আজ অনেক মূল্যের বিনিময়ে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে অনিয়ম অবিচারের উৎখাত করে বিশাল এক প্রাথমিক বিজয় অর্জন করেছে। কিন্তু এই প্রাথমিক বিজয়ই ‘রাষ্ট্রক্ষমতা’ অর্থাৎ স্বৈরাচারের বিদায়ের পর কে সেখানে বসবে সেই প্রশ্নটিকে আজ তাদের এবং জাতির সামনে নিয়ে এসেছে। এ কথা সত্য যে, এ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা নিজেরা কখনো প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হতে চাননি বা চাওয়ার কোনো কথাও ছিল না। সেজন্যই হয়তো জনগণের রয়েছিল তাদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তাই রাস্তায় যখন নিঃস্বার্থ তরুণরা প্রাণ দিয়েছেন, তখন জনগণও অকুণ্ঠভাবে তাদের পাশে বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাদের কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো দেশের অর্থনীতি। বেশ কিছুদিন ধরে কোনো রকমে গোঁজামিল দিয়ে চালানো হচ্ছিল। কিন্তু এই খাতে দ্রুত দৃশ্যমান উন্নতি করতে হলে স্টেকহোল্ডারদের আস্থায় নিতে হবে। দেশের পুঁজিবাজার, ব্যাংক ব্যবস্থা, আমদানি-রফতানি কার্যক্রমকে গতিশীল করতে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে।
Advertisement
আওয়ামী লীগের মতো সবচেয়ে পুরাতন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল এ আন্দোলনের শুরু থেকেই কেন যেন বারবার হোঁচট খেতে থাকে। দলীয় সভাপতির ক্যারিশমায় বছরের পর বছর পার পেয়ে যাওয়ায় মনে হচ্ছিল অন্য নেতৃবৃন্দ চিন্তা করার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছেন। না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সূচিত আন্দোলন মোকাবেলায় সেখানকার কালচার ও পলিটিক্স গভীরভাবে বোঝেন এমন লোকদেরই তো সামনে আনার কথা। অথচ যে চারজন মন্ত্রীকে সামনে আনলেন তাদের কেউ জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখাই করেননি। ফলে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বোঝা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কানেকশন সৃষ্টি হওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। তারা শিক্ষার্থীদের পালস না বুঝে ভিনগ্রহের প্রাণীর মতো বিক্ষিপ্ত কথা বলতে থাকেন। পাশাপাশি গত শতাব্দীর মুখস্ত কিছু টার্ম ব্যবহার করে আসল সমস্যাটাকে অবজ্ঞা করতে থাকেন। ফলে উভয় পক্ষের মাঝে দূরত্ব বাড়তে থাকে। হতাশ হতে থাকে দেশের মানুষ।
এমন সমস্যার সমাধানে আলোচনার বিকল্প নেই। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা শুরু থেকে সে পথে হাঁটেননি। বরং বলপ্রয়োগ ও নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে সেটাকে ম্যানেজ করতে সচেষ্ট ছিলেন। এক পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে তিন সদস্যের এক কমিটি করলেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আপাতদৃষ্টে সফল হয়েছে। তাদের চোখে-মুখে যে ক্ষোভ ও প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেছিল তা প্রশমনে এটা যথেষ্ট। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তার লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। ঝানু রাজনীতিবিদদের বিপরীতে আবেগের বশে সাময়িক জয় পাওয়া গেলেও আসল চ্যালেঞ্জ সামনে।
পুলিশ নিজেদের জানমাল রক্ষায় সাময়িক নিষ্ক্রিয় থাকবে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যান্য বাহিনী তো মাঠে আছে। তারপরও সরকার পতনের দিন থেকে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে তা ছিল বড় ধাক্কা। বাধাহীনভাবে সবাইকে গণভবনে ঢুকতে দেয়া কি অনিবার্য ছিল? তাদের তো সংসদ ভবনের ওপর ক্ষোভ ছিল না। তাহলে সেটা অরক্ষিত রেখে অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ করে দিল কারা? পাশাপাশি বিরোধী নেতাকর্মী ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি বা উপাসনালয়ে হামলা হতে পারে— এমন অনুমান করে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হলো না কেন?
Advertisement
এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো দেশের অর্থনীতি। বেশ কিছুদিন ধরে কোনো রকমে গোঁজামিল দিয়ে চালানো হচ্ছিল। কিন্তু এই খাতে দ্রুত দৃশ্যমান উন্নতি করতে হলে স্টেকহোল্ডারদের আস্থায় নিতে হবে। দেশের পুঁজিবাজার, ব্যাংক ব্যবস্থা, আমদানি-রফতানি কার্যক্রমকে গতিশীল করতে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। একদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অন্যদিকে যাদের এ ব্যাপারে সহযোগিতা করার সামর্থ্য রয়েছে তাদের ইনভলভ করতে হবে। যেমন এ আন্দোলনে প্রবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া ছিল। সেটাকে দেশ গঠনে কাজে লাগাতে হবে। আগামীতে বিপুলসংখ্যক রেমিট্যান্স পাঠানোর লক্ষ্য ঠিক করে তাদের প্রতি আহ্বান জানানো যেতে পারে। প্রবাসীরা চাইলে ডুবন্ত অর্থনীতিকে টেনে ধরা সম্ভব। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গবেষণা ও কাজ করছেন—এমন বাংলাদেশী গুণীজনকে দেশ গঠনে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুণগত ও সংখ্যাগত উন্নয়ন দ্রুত হওয়া সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এএসএম