মতামত

আজ ১৫ আগস্ট: বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি নির্লিপ্ত বিচার

আজ ১৫ আগস্ট। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসের এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দিন। এই দিনটি গোটা জাতির পালন করার কথা ছিল। এদেশের মানুষ নারী শিশু হত্যা পছন্দ করে না। সেই অর্থে যে যেই দল বা আদর্শে বিশ্বাস করুক না কেন, অধিকাংশ মানুষের একটি সমবেদনা আছে ওই হত্যাকান্ডের বিষয়ে এবং ওই হত্যাকান্ডে দোষিদের দোষি বলার ক্ষেত্রে কোনো কার্পন্য নেই সাধারণ মানুষের মাঝে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে এই দেশেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট দিয়ে ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৮ সালে ক্ষমতায় বসিয়েছিল এতেও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মুশকিল হল, সেই সিমপ্যাথি আওয়ামী লীগ অনেকগুলো কারণে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত দিনটিকে শুধু নিজেদের, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের করে ফেলেছিল। এমনকি জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দলীয় নেতা বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথিবীর অন্যতম একজন দুঃখী মানুষ। এভাবে কোনো মানুষের পিতা, মাতা, ভাই, চাচা, ভাই, ভাইয়ের বউ হত্যার পর কেউ বেঁচে থাকেনি। শেখ হাসিনা এবং রেহানাই এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম। কিন্তু দেশব্যাপি এমন সব ঘটনা ঘটে আসছিল যে দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ এই দুঃখী মানুষটির প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে বরং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল। দল এবং দলের নেতাদের সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল তারা দেয়ালের লেখন পড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। লুটতরাজ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয়করণ এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিল যা বিগত দিনের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। ঢেকে দিয়েছে বিএনপি জামাতের অপরাধ-কুকর্ম, যা আন্দোলনকারী বর্তমান প্রজন্ম দেখেনি। ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাভোগকারীরা সমালোচনা সহ্য করতো না একেবারে। কেউ যদি গঠনমূলক সমালোচনাও করতো, তাকে রাজাকার বলে চিহ্নিত করতো দলের নেতারা, অথচ তারা বহু রাজাকারকে আওয়ামী লীগার সার্টিফিকেট দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে। এসব মানুষ নিরবে দেখেছে।

Advertisement

আওয়ামী লীগ বিগত ১৫ বছরে যা করেছে তাকে দলীয়করণ বললে ভুল হবে। দলীয়করণ করলেও একটা কথা ছিল। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা অর্থলাভকরণ, মামা-ভাগ্নেকরণ করেছে। একটি প্রাথমিক স্কুলে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আশির্বাদপুষ্ট না হলে চাকরি করা দুরূহ হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের সরকার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনেক উচ্চবাচ্য করেছে, কিন্তু একটি সিন্ডিকেট ভাঙেনি। প্রতিটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা জড়িত ছিল। ওই শাসন আমলে আদালতকে প্রায় পুলিশের থানার পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। থানায় যেসব হতো, আদালতেও তাই হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালতের রেট থানার চেয়ে কম ছিল। এসব আমরা দেখেছি, জেনেছি এবং বিভিন্ন সময়ে পুরোপুরি না বলতে পারলেও ইনিয়ে বিনীয়ে বলেছি। আমার বিভিন্ন লেখায় তা আছে।

কিন্তু একটি দুঃশাসনকে বিতাড়িত করে আপনারা কি আরেকটি দুঃশাসনের সূত্রপাতের দিকে ধাবিত হচ্ছেন? এ প্রশ্ন করতেই পারি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৃশংসভাবে খুন হন। ছোট্ট রাসেলের মাথায় ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। যে মানুষটি দিনের পর দিন জেল খেটে, বারবার মৃত্যুর মুখে পতিত হয়ে এই দেশটিকে পাকিস্তানের মত মিলিটারি শক্তি নির্ভর একটি দেশ থেকে মুক্ত করলেন, তার পরিবারসহ হত্যা হওয়াটা কি শোকের নয়? আপনারা সেই শোকের দিনটিকে বাতিল করে কী মেসেজ দিলেন এই জাতিকে? ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি এবং স্মৃতি জাদুঘরটি পুড়িয়ে ভস্মিভূত করার পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সেখানে গিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা এক নয়। এই দৃশ্য দেখার আগে আমার মৃত্যু হলেও ভালো ছিল।’ আলবৎ তাই। আপনারা যারা দেশকে ভালো করার দায়িত্ব নিয়েছেন তারা কেন বলছেন না যে ওই বাড়ি-স্মৃতি জাদুঘর যারা পুড়িয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে? চোখের সামনে কারা ওই মহান ব্যক্তিটির ভাস্কর্য ভেঙে ধূলিস্মাত করল, তার ওপর প্রস্রাব করল, তাদের কি বিচারের আওতায় আনবেন না? দেশের প্রচুর মানুষ, এমনকি আন্দোলনকারী অনেককে দুঃখ প্রকাশ করতে শুনেছি এ নিয়ে।

আমি হলফ করে বলতে পারি, সারা জীবনে কোনো বেনিফিট নেওয়া তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগের এক কাপ চাও-খাইনি। তাই সত্য বলতে আমার দ্বিধা নেই। যারা এতকাল আওয়ামী সরকারের বেনিফিট নিয়েছে পদে পদে, বাড়ি-গাড়ি-প্রতিষ্ঠান, কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়েছেন তাদেরকে বিস্ময়ের সঙ্গে মুহূর্তে ভোল পাল্টে ফেলে দেখছি। যাহোক, আবারো বলছি, আওয়ামী লীগের অসংখ্য ত্রুটি ও ভুল আছে। সেটার দায় বঙ্গবন্ধুর উপর চাপিয়ে দেওয়া কেন? যারা দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলছেন, তারা জেনে বা না জেনে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করছেন। কারণ একটি ভূখন্ড, একটি স্বার্বভৌমত্ব দ্বিতীয়বার স্বাধীন হতে পারে না। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনকে স্বাধীনতা-পরাধীনতার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার অর্থ কী?

Advertisement

বর্তমানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তাদের অন্তত তিনজন উপদেষ্টাকে আমি চিনি। তারা সজ্জন এবং ন্যায্য কথা বলতে অভ্যস্ত। পরিচ্ছন্ন ইমেজের মানুষ। কিন্তু সে ন্যায্য কথাটা কী সেটা বুঝতে আমাদের কখনো কখনো ভুল হয়ে যায়। বর্তমান এই সরকার প্রধানত দায়িত্ব নিয়েছে একটি লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি করে নির্বাচন দিতে। কিন্তু সারা দেশে যদি এমন একটি আবহ তৈরি হয় যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ দল, তাহলে সেটা কতটা লেভেল প্লেইং ফিল্ড হবে? যদি সুষ্ঠু একটি নির্বাচন করেন সামনের দিনে সেখানে জনগণকে তার মত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে দিতে হবে এটাই তো কথা। তারা কেউ আওয়ামী লীগকে শত অপকর্মের পরও যদি চায়, তাতেও তো কিছু করার নেই। না চাইলে তারা নির্বাচনে আসন পাবে না। সোজা হিসাব।

এসব নিয়ে আর নাই বলি। বঙ্গবন্ধুর কথায় ফিরে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাদের চোখের সামনে অপমানিত হলে আমাদের দেশ অপমানিত হয়, আমাদের জাতি অপমানিত হয়, একথা কিছু টোকাই না বুঝতে পারে, ছাত্র আন্দোলনের মেধাবী শিক্ষার্থী এবং সরকারের দায়িত্ব নেওয়া ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই বোঝেন এবং অনুভব করেন। তারপরও বঙ্গবন্ধুকে এই শোকের দিনে বর্তমান আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশিয়ে না ফেলতে অনুরোধ করছি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।

এইচআর/এএসএম

Advertisement