রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদের পদত্যাগের দাবিতে আলটিমেটাম দিয়েছেন অধীনস্থ বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তারা উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদেরও পদত্যাগ দাবি করেছেন।
Advertisement
‘দলবাজ’ হিসেবে পরিচিত উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে পদত্যাগে শিক্ষার্থীরা যখন আলটিমেটাম দিচ্ছেন, ঠিক তখন নিজেদের অনুসারীদের গণপদোন্নতি দেওয়ার পথে হেঁটেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শীর্ষ দুজন কর্মকর্তারা। এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা দ্রুত গণপদোন্নতি বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে পদত্যাগ না করলে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছেন।
জানা গেছে, দলীয় বিবেচনায় ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদ। বছর না পেরোতেই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) এ নিয়ে লিখিত অভিযোগও জমা পড়ে, যা এখন তদন্তাধীন।
রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের পদত্যাগে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আলটিমেটামে উপাচার্যরা পদত্যাগ করেছেন
Advertisement
রাজনৈতিক বিবেচনায় উপ-উপাচার্য হিসেবে তারও আগে নিয়োগ পান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি, অনিয়মের একগুচ্ছ অভিযোগ জমা পড়ে ইউজিসিতে, যা তদন্তাধীন।
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আলটিমেটামশেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের পদত্যাগে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আলটিমেটামে উপাচার্যরা পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি শিক্ষার্থী না থাকায় কিছুটা ‘সেফ জোনে’ রয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুর রশীদ ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ।
পদত্যাগের জন্য তো চাপ আছেই। আমি তো কোনো দল করি না। যখন নিয়োগ হয়েছিল, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। তারা আমাকে যোগ্য মনে করেছেন বলে নিয়োগ দিয়েছেন। পরিস্থিতি যা, তাতে আমি হয়তো থাকবো না।- উপাচার্য আবদুর রশীদ
তবে গত তিন-চারদিন বিশ্ববিদ্যালয়টির অধীনস্থ বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগে আলটিমেটাম দিচ্ছেন। তার বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়ম তুলে ধরে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তাদের অপসারণ দাবি করছেন।
Advertisement
গাজীপুরের একটি মাদরাসায় ফাজিলে পড়াশোনা করছেন গোলাম মোরশেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘উপাচার্য অধ্যাপক আবদুর রশীদ চরম মাত্রার একজন দলবাজ। উনি ভিন্ন মতাদর্শের কাউকে সহ্য করতে পারতেন না। কারণ ছাড়াই তাদের হয়রানি করতেন। বিভিন্ন কাজে বছিলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় রাখতেন। তারপর সংশোধনসহ বিভিন্ন কাজে অনৈতিকভাবে তার অনুসারীদের দিয়ে ঘুস নিতেন। আমরা তার এবং উপ-উপাচার্যের পদত্যাগে আলটিমেটাম দিয়েছি। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের পদত্যাগ করতে হবে।’
রাজবাড়ীর একটি মাদরাসার অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘উনি (অধ্যাপক আবদুর রশীদ) মুখে ধর্মীয় কথা বললেও টাকা ছাড়া ফাইল নড়তো না। বিভিন্ন কাজে, নানা অজুহাতে তার লোকজন ফোন করে টাকা দাবি করতেন। চাকরি খেয়ে ফেলার ভয় দেখাতেন। আবদুর রশীদ চক্রের হুমকিতে অধিকাংশ মাদরাসার অধ্যক্ষ ও শিক্ষক তটস্থ। আর দুর্নীতির শিরোমণি উপ-উপাচার্যও। তাদের বিরুদ্ধে ইউজিসিতে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। এ দুজনের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। তাদের সরে যেতে হবে।’
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে পদত্যাগ করবেন কি না, জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদত্যাগের জন্য তো চাপ আছেই। আমি তো কোনো দল করি না। যখন নিয়োগ হয়েছিল, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। তারা আমাকে যোগ্য মনে করেছেন বলে নিয়োগ দিয়েছেন। পরিস্থিতি যা, তাতে আমি হয়তো থাকবো না। সবার পরামর্শ চাই। আপনারাও পরামর্শ দিয়েন, কী করা উচিত।’
তবে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলেও রিসিভি করেননি। পরে এসএমএস দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
২৫০ জনকে তড়িঘড়ি পদোন্নতির ‘পাঁয়তারা’শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক আবদুর রশীদকে পদত্যাগ অথবা সরিয়ে দেওয়ার দাবি তুললেও তিনি ব্যস্ত অনুসারীদের পদোন্নতি দেওয়ার কাজে। উপাচার্য নিজে দূরে থেকে কৌশলে কর্মকর্তাদের দিয়ে এ কাজ করাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পর থেকে নিজেকে অসুস্থ দাবি করে বাসায় অবস্থান করছেন উপাচার্য। তবে বাসায় বসে নিজের অনুসারীদের গণপদোন্নতি দেওয়ার ‘কলকাঠি’ নাড়ছেন তিনিই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন সহকারী রেজিস্ট্রার পদমর্যাদার কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেটা উপেক্ষা করে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার জন্য মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া সরাসরি জনবল নিয়োগে যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, তাদের ডাকা হয়নি। শেষ সময়ে শুধু নিজের অনুসারীদের পদোন্নতি দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
নিয়োগপ্রাপ্তদের কেউ এ পর্যন্ত পদোন্নতি পাননি। তারা বৈষম্যের শিকার। ছাত্র-জনতা বৈষম্যের বিরুদ্ধে এখন লড়াই করে জয় পেয়েছেন। তাদের প্রত্যাশা—এমন প্রেক্ষাপটে তারাও বৈষম্যমুক্ত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় পাবেন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৩ আগস্ট থেকে পদোন্নতি দিতে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেছে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। ওইদিন অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার টাইপিস্ট, মালি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ড্রাইভার পদে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। বুধবার (১৪ আগস্ট) নেওয়া হয়েছে সেকশন অফিসার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সহকারী রেজিস্ট্রার পদের মৌখিক পরীক্ষা। আগামী ১৭ আগস্ট ইংরেজি, ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিভাগে শিক্ষকদের পদোন্নতির ভাইভা রয়েছে।
১৮ আগস্ট উপ-রেজিস্ট্রার, উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন), প্রোগ্রামার, সহকারী পরিদর্শক পদে ৪৮ জনের ভাইভা নেওয়া হবে। এছাড়া ১৯ আগস্ট সহকারী পরিচালক (অর্থ ও হিসাব), সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ), সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘হ্যাঁ, পদোন্নতির কার্যক্রম চলছে। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ পদোন্নতি। ১৩ তারিখ থেকে সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি চলমান।’
তড়িঘড়ি পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে পদোন্নতি ও নিয়োগের বিধি ছিল। ফলে প্রতিষ্ঠার পর থেকে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের পদোন্নতি হয়নি। সবাই চাইছেন এ সময়টাতে যেন তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। তবে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অনুমোদন ছাড়া তো এটা করা সম্ভব নয়।’
পদোন্নতি দেওয়ার জন্য তার ওপর চাপ আছে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুর রশীদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাদের (শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী) পদোন্নতি দরকার, তারা যোগ্যও। তবে এ মুহূর্তে এমন তড়িঘড়ি করে করাটা মনে হয় উচিত হচ্ছে না। তাদের দিক থেকে আমাদের ওপর চাপও আছে। নিয়োগ ও পদোন্নতি বোর্ড কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছে। আমি অনেক দিন ধরে অসুস্থ, বাসায় আছি। তাদের সঙ্গে একটু কথা বলুন। আমি হয়তো আর এখানে (উপাচার্য পদে) থাকবো না।’
বিষয়টি নিয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি কিছু জানি না। হয়তো আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জানতে পারেন। আমি আজই দায়িত্ব নিয়েছি। খোঁজ নিয়ে দেখবো, কী হচ্ছে সেখানে।’
যা বলছেন পদোন্নতিপ্রত্যাশীরাপদোন্নতিপ্রত্যাশীরা অবশ্য নিজেদের বৈষম্যের শিকার বলে দাবি করেছেন। পদোন্নতির আশায় থাকা দুজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, প্রতিষ্ঠার পর থেকে যারা এ পর্যন্ত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছেন, তারা কেউ পদোন্নতি পাননি। তারা বৈষম্যের শিকার। ছাত্র-জনতা বৈষম্যের বিরুদ্ধে এখন লড়াই করে জয় পেয়েছেন। তাদের প্রত্যাশা—এমন প্রেক্ষাপটে তারাও বৈষম্যমুক্ত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় পাবেন।
এএএইচ/এমকেআর/জেআইএম