মতামত

সোনার বাংলা গড়ার সোনালী সময়

অবিরাম একের পর এক ঘটন-অঘটন ও বলপ্রয়োগে দমননীতির অনিবার্যতায় ৫ আগস্ট করুণভাবে সরকার পতন। দাপুটে একজন প্রধানমন্ত্রীর দেশ ছেড়ে পলায়ন। অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নৈতিক জয় ৫ আগস্টের ঢের আগেই। তাদের ওই জয় মানে সরকারের পরাজয় নয়। কারণ এ আন্দোলনকারীরা ক্ষমতার প্রার্থী ছিল না। সরকারকে হটানো তাদের এজেন্ডাও ছিল না।

Advertisement

তাদেরটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে নিরীহ-নির্দোষ একটি সামাজিক আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। কিন্তু, সরকার বিষয়টিকে সেভাবে না নিয়ে তাদেরকে কেবল রাজাকারের নাতিপুতি নয়, ক্ষমতার প্রতিপক্ষও বানিয়ে ফেলে। শেষতক তাই হলো। করুণ পরিণতিতে পালিয়ে বাঁচতে হলো শেখ হাসিনাকে। তার পলায়নের পরে কয়েক দিন বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। এই সময়টাতে তাঁর দলের কর্মী সমর্থকদের ওপর তীব্র আক্রমণ হয়েছে এবং সারা দেশে নৈরাজ্য হয়েছে। শত শত থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংসদ ভবনে পর্যন্ত ভাঙচুর হয়েছে।

এবারের আন্দোলটি কোটা নিয়ে সূত্রপাত হলেও তা আর কোটাতে ছিল না- তা সামান্য বুঝজ্ঞাসম্পন্ন মানুষও বুঝেছে। জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে। পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনের অ্যাকশন ব্যর্থ হওয়ার পর সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু, ততক্ষণে আর নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। একটা গণ–অভ্যুত্থান যে কতভাবে মানুষের প্রচলিত চিন্তার মূলে ধাক্কা দিতে পারে, মানুষের ভাবনাকে বদলে দিতে পারে, তার নজির কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশ দেখছে।

তরুণেরা দেখিয়েছে, দেশটাকে বদলানো সম্ভব। ওরা এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। চাই সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন। অর্থনীতি কতটুকু এগোল আর কতটুকু ভগ্ন হলো, এ হিসাব এখন সামনে আনার সময় নয়। সময় এখন সোনালী বাংলাদেশ গড়ার। সময় থেমে থাকে না। বর্তমানের সময়গুলো মুহূর্তে মুহূর্তে অতীত হোক, ভবিষ্যতও হোক।

Advertisement

৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিন–চার দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর, দখল, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও চাঁদাবাজি হতে থাকে। এসব দুঃখজনক ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লুট হওয়া সম্পদ ফেরত দেওয়ার আওয়াজ ওঠে। কিছু মানুষ তাতে সাড়া দেয়। এটা নিঃসন্দেহে সমাজের সবখানে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আশার প্রতিফলন। এই দৃষ্টান্ত দেশের অন্যখানেও অনুসরণীয় হতে পারে।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ, ধানমন্ডি ৩২ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসহ দেশের অসংখ্য স্থাপনা এবং বাড়িঘরে হামলা, লুটপাটের কিছু মালও ফেরত পাওয়া গেছে। যা বাংলাদেশে ভালো-মন্দের সমান্তরাল চলার একটি নজির। এই ভালো-মন্দকে সঙ্গী করেই এখন দেশকে একটি অবস্থানে নেয়ার অভিযাত্রা নোবেলজয়ী ড. ইউনূস সরকারের। স্থানিক ও আন্তর্জাতিক স্তরে থাকা বিশাল পরিচিতি, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এনজিও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক ব্যবসা প্রসারে দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়ার অভিজ্ঞতার সুবাদে ড. ইউনূস তাতে সক্ষম হবে বলে আশা করাই যায়।

কাজটা অবশ্যই কঠিনের চেয়েও কঠিন। দেশের মূলধারার কোনো দলই দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত নয়। তাই আশাবাদী হয়েও আশাহত হতে হয়। আরব বসন্তের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা ‘আরব শীত’ হয়ে যাওয়ার কথা সামনে চলে আসে। আরব বিশ্বের গণ-অভ্যুত্থান আংশিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল কারণ সেখানকার রাজনীতিতে তরুণদের ভূমিকা খুবই সীমিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এই জেনারেশন-জেড (জেন-জি) আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে একজন স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েই থেমে যায়নি। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার আগে সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং বয় স্কাউটরা ট্রাফিক পুলিশ, নগর পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নিরাপত্তা কর্মীর দায়িত্ব পালন করেছে। মাদ্রাসার ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকছে। এ হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য মানুষকে একটি সুন্দর আগামীর নমুনা দেখাচ্ছে।

গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন ও রক্ষা এখন ছাত্র-জনতা সবার দায়িত্ব। ছাত্র-জনতা সব পক্ষের উচিত হবে এই বিজয় ও ঐক্যকে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্যে রূপান্তর করে প্রতিবিপ্লবের ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া। বাংলাদেশ এই প্রথম একটি সরকার পেয়েছে, যেটি ছাত্রদের নেতৃত্বে জনতার অভ্যুত্থানের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

Advertisement

এই সরকারে আন্দোলনকারী নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আছে। তাই সব পক্ষের উচিত এই বিজয় ও ঐক্যকে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্যে রূপান্তরিত করে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে যাতে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে আর কোনো শাসক এমন ফ্যাসিস্ট ও জুলুমবাজ হয়ে উঠতে না পারে। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার এখনই সোনালি সময়।

স্বাধীনতার পর যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, পুলিশ-প্রশাসন-বিচার বিভাগ তাদের চাটুকারে পরিণত হয়েছে। অর্থের ঝনঝনানিতে চাপা পড়েছে ন্যায়বিচারের ক্ষীণকণ্ঠ। একজন সাধারণ মানুষ ধনী ক্ষমতাবানের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কখনো ন্যায়বিচার পায়নি। বরং আরও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। আমি চাই দেশে আইনের নিরপেক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। ক্ষমতায় যে-ই বসুক, সাধারণ মানুষ যেন তার দিকে নির্ভয়ে আঙুল তোলার স্বাধীনতাটুকু পায়। ক্ষমতা যেন আমাদের বর্তমানের ক্ষমতাবানদের পাল্টে না দেয়। আমরা আর পাল্টে যাওয়া মুখোশ পরা মানুষ দেখতে চাই না।

আগের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিল। আশা করেছিল, অধিকার ফিরে পাবে মানুষ। সব অসাম্য দূর হবে। সেই উত্তরাধিকার নিয়ে আমাদের প্রজন্ম গর্বিত হলো। কিন্তু , বাস্তবটা হলো বিপরীত। মানুষে বৈষম্য আরও বেড়ে গেল। নতুন প্রজন্ম নতুন করে ভাবছে। তারা বৈষম্য আর দেখতে চায় না। দেশকে এগিয়ে নিতে চায়। অথচ তাদের নিয়ে আমাদের কত অভিযোগ ছিল।

ওরা বই পড়ে না। ওরা ডিভাইসে আসক্ত। ওরা রাজনীতি-সচেতন না। ওদের হাতে বাংলাদেশ ভালো থাকবে না। সব ভুল ওরা ভেঙে দিয়েছে। আমাদের বিস্মিত করেছে। কীভাবে এক হতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয়, ওরা দেখিয়েছে। ওরা প্রমাণ রেখেছে, ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দেশ বড়, দেশের মানুষ বড়। আমাদের ব্যর্থতা, আমরা এই বাংলাদেশকে ওদের উপযোগী করে রাখতে পারিনি। অনেক পাপ আমাদের জমেছে। অনেক দায় আমাদের রয়েছে। এখন সময় এসেছে পাপ মোচনের, দায় মেটানোর।

আমরা, মানে আমাদের প্রজন্ম আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। মনে করেছিলাম, সন্তানের পড়াশোনার জন্য এ দেশ নয়। বসবাসের জন্য এ দেশ নয়। এ দেশে কাজ নেই। মেধার মূল্যায়ন নেই। দলবাজি ছাড়া বুঝি সুযোগ মেলে না। আমরা এসব ভেবেছি। কিন্তু কখনো ভেবে দেখিনি, দেশটাকে বদলানোর উপায় ছিল। সেই উপায়কে আমরা কাজে লাগাইনি। কিন্তু তরুণেরা দেখিয়েছে, দেশটাকে বদলানো সম্ভব। ওরা এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। চাই সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন। অর্থনীতি কতটুকু এগোল আর কতটুকু ভগ্ন হলো, এ হিসাব এখন সামনে আনার সময় নয়। সময় এখন সোনালী বাংলাদেশ গড়ার। সময় থেমে থাকে না। বর্তমানের সময়গুলো মুহূর্তে মুহূর্তে অতীত হোক, ভবিষ্যতও হোক।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/এএসএম