দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়েই চলেছে। বজ্রপাত প্রতিরোধে এরই মধ্যে কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। যদিও আশানুরূপ কোনো ফল মেলেনি। নতুন একটি প্রকল্পে ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার ব্যয় প্রস্তাব করেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। সব বিবেচনা করে মাত্র ১০০ কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
Advertisement
‘দেশের অধিক বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় বজ্রপাতের ফলে প্রাণহানি রোধে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ’ প্রকল্পের আওতায় ঘটেছে এমনটি। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বজ্রনিরোধক দণ্ড পাশাপাশি অবস্থিত অন্য ভবন/স্থাপনার চেয়ে উঁচুতে স্থাপন করতে হবে। বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের ধারণাটি এদেশের প্রেক্ষাপটে তুলনামূলকভাবে নতুন হওয়ায় আপাতত: পাইলটিং আকারে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ জেলাসমূহে স্থাপন করাই সমীচীন হবে। সেক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ১৫টি জেলা নির্ধারণ করে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় সর্বোচ্চ ১০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমিত রেখে দুই বছর মেয়াদ নির্ধারণ করে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) পুনর্গঠন করতে হবে। ডিপিপি পুনর্গঠন করে পুনরায় প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর সুপারিশ করেছে কমিশন।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার প্রস্তাব করেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। তবে এমন প্রকল্প নতুন হওয়ায় আমরা পাইলট প্রকল্প হিসেবে ১০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বলেছি।- পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান মো. ছায়েদুজ্জামান
Advertisement
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্প অন্তর্ভুক্তির বিষয় বিবেচনার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রোগ্রামিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় প্রকল্পটি প্রস্তাবিত আঙ্গিকে বাস্তবায়নের আগে পাইলট প্রকল্প হিসেবে কিছুসংখ্যক বজ্রনিরোধক স্থাপনের সংস্থান রেখে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ ধারণাটি যেহেতু নতুন সেহেতু এ পর্যায়ে ১৫টি জেলায় কার্যক্রম বাস্তবায়ন না করে পাইলট আকারে স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম প্রক্রিয়াকরণ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ও কমবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. ছায়েদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার প্রস্তাব করেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। তবে এমন প্রকল্প নতুন হওয়ায় আমরা পাইলট প্রকল্প হিসেবে ১০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বলেছি। আগে এটার কাজ দেখি। এটা যদি ভালো হয় তবেই পরবর্তীসময়ে বড় পরিসরে চিন্তা করা যাবে। তবে এখন ১০০ কোটি টাকার বেশি দেওয়া যাবে না। যেহেতু জানমাল রক্ষার একটা বিষয় এখানে জড়িত তাই দুই বছর দেখি সফল হওয়া যায় কি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অধিক বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় বজ্রপাত থেকে মানুষ ও প্রাণিসম্পদের সুরক্ষাসহ বজ্রপাত থেকে অবকাঠামো, বৈদ্যুতিক স্থাপনা, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সুরক্ষা এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমানো জরুরি। এজন্য ৬ হাজার ৭৯৩টি বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন ও ৩ হাজার ৩৯৮টি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।’
Advertisement
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৪০৭ জনের। অধিক বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় ২০১৮-২০২১ সাল পর্যন্ত চার বছরে মারা গেছেন ৫৬৭ জন। হতাহতদের মধ্যে ৯৩ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের।
অধিক বজ্রপাতপ্রবণ জেলা ১৫টিবজ্রপাতপ্রবণ যে ১৫ জেলায় প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে- সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও জামালপুর। বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের ধারণাটি এদেশের প্রেক্ষাপটে তুলনামূলকভাবে নতুন হওয়ায় আপাতত পাইলটিং আকারে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোতে স্থাপন করাই সমীচীন বলে মনে করছে কমিশন। সেক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ১৫টি জেলা নির্ধারণ করে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় সর্বোচ্চ ১০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমিত রেখে জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৬ পর্যন্ত দুই বছর মেয়াদ নির্ধারণ করে ডিপিপি পুনর্গঠন করতে হবে।
ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের ১৫টি জেলার ১৪২টি উপজেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্প প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘প্রতি বছরই বজ্রপাতের কারণে প্রাণহানি বাড়ছে। প্রাণহানি কমানোর জন্য আমরা একটা প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছি। এটা একেবারেই প্রাথমিক ধাপে আছে। আমরা প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি।’
প্রকল্পটি গ্রহণের যৌক্তিকতার বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন পরিকল্পনা কমিশনকে জানান, বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটিতে নিয়মিত সংঘটিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সম্প্রতি বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে।
প্রকল্পের আওতায় অধিক বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় ১ হাজার ৬৯৯টি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ বাবদ ফুটিং ফাউন্ডেশন ১৭৫ কোটি ও পাইল ফাউন্ডেশন ২২৯ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। সে হিসাবে প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য ফুটিং ফাউন্ডেশন বাবদ ১০ লাখ ৩৩ হজার টাকা ও পাইল ফাউন্ডেশন বাবদ সাড়ে ১৩ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
কখন, কোথায় বজ্রপাত হয়যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন দেশটির কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান। তিনি তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, প্রাকবর্ষা মৌসুমে (মার্চ-এপ্রিল-মে) বেশি বজ্রপাত হয় হাওরাঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায়। পুরো বর্ষা মৌসুমে (জুন-জুলাই-আগস্ট) বজ্রপাত বেশি হয় সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে। বর্ষা মৌসুমের পরে (অক্টোবর-নভেম্বর) বেশি বজ্রপাত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে। এমনকি শীতকালেও বজ্রপাত থেকে রক্ষা নেই। এসময় সাতক্ষীরা, খুলনা ও পটুয়াখালীতে বেশি বজ্রপাত হয়।
এমওএস/এএসএ/জিকেএস