বাংলা গানের অন্যতম শ্রোতানন্দিত সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা। জাদুকরী কণ্ঠে গান গেয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন এ দেশের সব শ্রেণির গানপ্রিয় মানুষের হৃদয়ে। বিগত কয়েক দশক ধরে তিনি সিনেমার গানে হয়ে উঠেছিলেন অনিবার্য নাম। চলচ্চিত্র নির্মাতরা গানের জন্য তাকে রাখতেন পছন্দের শীর্ষে। রাজনীতিতেও নাম লিখিয়েছিলেন এই শিল্পী। শুধু তাই বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দলের (বিএনপি) প্রার্থী হিসেবে জাতীয় নির্বাচনে অংশও নিয়েছিলেন। দেশের বর্তমান পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে রাজনীতি ও সমাজসচেতন এই শিল্পী কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান মিথুন।
Advertisement
জাগো নিউজ: কেমন আছেন?
কনকচাঁপা: আলহামদুলিল্লাহ, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আছি মোটামুটি।
জাগো নিউজ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর দেশ যে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে, সে বিষয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
Advertisement
কনকচাঁপা: অনেক দিন ধরেই আমরা নিগৃহীত, অত্যাচারিত ছিলাম। এর মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়াতে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, কেউ এর যথাযথ প্রতিবাদ করতে পারছিল না। কেউ আসলে সেই অর্থে প্রতিবাদ করতে মাঠে নামেনি বা নামতে পারছিল না। এসব দেখে আমার মনে হয়েছিল, একসময় এ জাতির যে শক্তি ছিল, অসীম সাহস ছিল, তা বোধহয় হারিয়ে গেছে। সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করলেও এ ব্যাপারে কিন্তু কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। একথা স্বীকার করে নিচ্ছি, আমিও ঘর থেকে বের হইনি। সব মিলিয়ে ভাবছিলাম, আমরা মনে হয় কাপুরুষের জাতি। কিন্তু নতুন জেনারেশন প্রতিবাদ করে দেখিয়ে দিয়েছে।
কনকচাঁপা। ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে
জাগো নিউজ: নতুন এই প্রজন্মের প্রতি সবার একটা বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছিল। সেটা তো তাহলে ভুল ছিল, কী বলেন?
কনকচাঁপা: এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের প্রতি একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল কথাটি সত্য। আমরা মনে করতাম তারা কোনো কিছু বোঝে না। আমি আমার ছেলে-মেয়েদেরকেই একসময় বলেছি, ‘তোমরা সারাদিন ঘরে বসে থাকো। দেশের খবর রাখো না। দেশের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।’ কিন্তু আমার সে ধারণা ওরা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। ওরা আসলে দেশের সব ব্যাপারে এতটা ওয়াকিবহাল, দেশের প্রতিটি বিষয়ে এতটা অবগত, দেশকে এত বেশি ভালোবাসে – তা আমাকে অবাক করে দিয়েছে। ছাত্ররা যেভাবে বুলেটে বুক পেতে দিয়েছে, তা সত্যিকারার্থে সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছে।
Advertisement
জাগো নিউজ: অন্তর্বর্তী সরকারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও রাখা হয়েছে, বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
কনকচাঁপা: নতুন এ সরকারের সব সদস্যকেই আমার খুব ভালো লেগেছে। ২৮ বছর থেকে ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত, মানে নবীন-প্রবীণদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। এতে ছাত্রদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, প্রত্যেকটি সেক্টরের সেরা মানুষদের যেভাবে বাছাই করে জায়গা দেওয়া হয়েছে, এটি আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। যখন এ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান চলছিল, দেখে আমি অঝোরে কাঁদছিলাম। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম।
কনকচাঁপা। ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে
জাগো নিউজ: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে একজন নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব, এই ব্যাপারটি আপনাকে আলাদা করে উদ্দীপ্ত করেনি?
কনকচাঁপা: এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে কতশত অপপ্রচার চালানো হয়েছে। আমি তা কখনও বিশ্বাস করিনি। সারা পৃথিবীতে তিনি এমন একজন ব্যক্তি, এত সম্মানিত মানুষ, তার সম্পর্কে এমন এমন মিথ্যাচার করা হয়েছে, যা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। আমি কখনই এসব অপপ্রচারে কান দিইনি। এমন বিশ্ববরেণ্য, মেধাসম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান, কর্মযোগ্যতাময় মানুষটিকে ধারণ করার ক্ষমতা এই দেশ হারিয়ে ফেলেছিল। মহান এই মানুষটিকে বাংলাদেশ তার সেবায় ফিরে পেয়েছে, এটি হচ্ছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আমি ছাত্রদের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ যে, এই মানুষটিকে দেশের অভিভাবক হিসেবে তারা নির্বাচিত করেছেন। আমি আশা করব তিনিও আমাদের স্বপ্ন ও আশা পূরণে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন।
জাগো নিউজ: আপনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) সমর্থক হওয়ায় বিগত সরকারের আমলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে আপনাকে। সেসব ঘটনার কিছুটা জানতে চাই।
কনকচাঁপা: আমি বিগত সাতটি বছর বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছি, তাতে মোটেই ভেঙে পরিনি। আমি সবসময় হাসিখুশি থেকেছি। কখনো কাঁদিনি। কখনো হতাশ হইনি। যত সমস্যা এসেছে, কারও কাছে অভিযোগ করিনি। আমাকে সাত বছর যেভাবে বোবা করে রাখা হয়েছে, তা বর্ণনাতীত। আমি কোনো কিছু লিখতে পারতাম না। শুধু তাই নয়, আমি গান গাইতে পারিনি। একজন শিল্পী যদি গান গাইতে না পারে, তার বোবা হয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু আমি এতকিছুর পরও আশা হারাইনি। আমি বলতে চাই, এতদিন আমি বঞ্চিত ছিলাম বলে এখন সবকিছু উসুল করে নেব এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ আমি নই। আমার মন এমন লোভাতুর নয়। কর্মময় জীবন ছিল আমার, আমি আবার আমার সেই কাজে ফিরতে চাই।
জাগো নিউজ: যতদূর জানি, রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠান এবং প্রচারমাধ্যমে আপনাকে বিগত দিনগুলোতে সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
কনকচাঁপা: বাংলাদেশ বেতারে একজন কর্মকর্তা আমার গান বাজিয়েছিলেন। এ অপরাধে তাকে সাসপেন্ড (বরখাস্ত) করা হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) আমার কোনো গান বাজানো তো হয়ইনি, এমনকি নতুন প্রজন্মের কোনো শিল্পী আমার গান গাইতে চাইলেও তাকে বাধা দেওয়া হয়েছে। এই কথা আমাকে অনেক শিল্পীই জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমি একটি কথাই বলতে চাই, যে গান বা যার গান আকাশে বাতাসে ভাসে, তার গান কি কেউ বন্ধ করে করতে পারে? কথাটা কিন্তু আমি মোটেই অহংকার করে বলছি না। আমি এ কথা দিয়ে বোঝাতে চাই যে, আসলে মানুষ আমাকে ভোলেনি। আমার গান ভোলেনি। বিগত বছরগুলোতে সরকারি অনেক বড় বড় অনুষ্ঠান হয়েছে, সেখানে আমাকে ডাকা হয়নি। কোনো চ্যানেলে আমার গান বাজানো হয়নি।
জাগো নিউজ: এত সবের পরও তো আপনার কণ্ঠ থেমে থাকেনি। শুনেছি আপনি গান করেছেন।
কনকচাঁপা: হ্যাঁ, আমি আমার গানের চর্চা চালিয়ে গেছি। আমি গান গেয়ে আমার ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করেছি। আমি বিশ্বাস করি, যতই বন্ধ করা হোক, আলো যে কোনো জায়গা থেকে আসবেই।
কনকচাঁপা। ছবি: শিল্পীর ফেসবুক থেকে
জাগো নিউজ: গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কি কখনও কোনো সমস্যায় পড়েছিলেন?
কনকচাঁপা: আমাকে বিভিন্নভাবে বলা হতো, আমি যেন আমার গ্রামের বাড়িতে না যাই। আমি আমার কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে পরে শুনেছি তাদের বাড়িতে কে বা কারা ঢিল ছুঁড়েছে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে কি এখন আপনার গান প্রচার হচ্ছে?
কনকচাঁপা: ৫ আগস্ট, মানে যেদিন দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে, সেদিন থেকেই আমার গান বিটিভিতে বাজতে শুরু করেছে। পরের দিন থেকে বেতারেও গান বাজানো হচ্ছে। যদিও এ গান আমি এখনো শুনিনি। তবে বিটিভি ও বেতারে গান বাজানো হচ্ছে, তা আমার আমার নিকট জন ও আমার ফ্যানপেজ থেকে জেনেছি।
জাগো নিউজ: নতুন গান করছেন কবে?
এখন আসলে গান গাওয়ার সময় না। আমি মনে করি এখন বিশ্রাম নেওয়ার সময়। এখন একটু রেস্ট নিচ্ছি। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে আবার কাজে ফিরব। এখন অনেকেই গান নিজেরা করে, নিজেরাই সেটা প্রচারের ব্যবস্থা করে। আমি পেশাদার শিল্পী, আমি এসবে অভ্যস্ত নই। পরিবেশ শান্ত হোক, কেউ ডাকলে গান গাইব কি গাইব না, তা পরে দেখা যাবে। দেশটা আগে ঠিক হোক, এটিই এখন আমার বড় প্রত্যাশা।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কনকচাঁপা: আপনাকেও ধন্যবাদ।
এমএমএফ/আরএমডি/জিকেএস