মতামত

অটুট থাকুক ধর্মীয় সম্প্রীতি

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে। এদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। আমাদের এ দেশ অর্জিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার মিলিত রক্তস্রোতের বিনিময়ে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের সুযোগ গ্রহণ করে একটি সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশের বিভিন্ন স্থানে আহমদিয়া ও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করে।

Advertisement

যে বিষয়টি বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) দুপুর ২টা ১০ মিনিটে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেরার পরেই অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদেরকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি আইনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটেছে। মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্পদ চুরি হচ্ছে। অফিস-আদালতে আক্রমণ হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আহমদিয়া সবার ওপর আক্রমণ হচ্ছে। এগুলো হলো ষড়যন্ত্রের অংশ। এগুলো আমাদের বিষয় না। আমাদের কাজ হলো এদের রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষকে রক্ষা করা, প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই। একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসা।’

আমাদের সবার প্রত্যাশা দ্রুতই দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক হবে আর নতুন উদ্যম ও প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে এই শিক্ষাই ধর্মের শিক্ষা। ধর্ম মানুষকে সম্প্রীতি ও পরমত সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। ধর্মের সঠিক জ্ঞান অর্জন ও অনুশীলন মানুষের মনে সুন্দর অনুভূতির জন্ম দেয়। মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে ছিলেন। তাইতো তিনি লিখেছেন, গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।’ তিনি লিখেছিলেন ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

Advertisement

সমস্ত ধর্মীয় মতবিরোধ সত্তেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জগতসমূহের একমাত্র প্রতিপালক হিসাবে সবাইকে সমভাবে লালনপালন করে থাকেন। বিশ্বাসের বিরোধ থাকা সত্তেও সবাইকে একই মেঘের পানি দিয়ে তিনি সিঞ্চিত করেন। আস্তিক-নাস্তিক সবাইকে তাঁর সৃষ্ট সূর্য নিজের রোদ সমভাবে প্রদান করে। এই একই কাদামাটিতে সবাই চাষাবাদ করে সমানভাবে উপকৃত হয়। মহান আল্লাহর দয়া ও কৃপার এই সার্বজনিনতা মানুষকে, বিশেষ করে মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে, আমরাও যেন খোদার গুণে গুণান্বিত হয়ে সবার জন্য উদারতা প্রদর্শন করি।

নবীজি (সা.) তার ঘোরতর শত্ত্রু ও কাফেরের লাশকেও সম্মান প্রদর্শন করতেন। একবার হজরত সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) ও কায়স ইবনে সা’দ (রা.) কাদ্সিয়াতে বসা ছিলেন, তখন লোকেরা তাঁদের সামনে দিয়ে একটি জানাযা নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে তাঁরা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাঁদের বলা হল, এটা এ দেশীয় অমুসলিম জিম্মী ব্যক্তির জানাযা। তখন তাঁরা বললেন, ‘একবার নবী (সা.)-এর সামনে দিয়েও একটি জানাযা যাচ্ছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলে তাঁকে বলা হয়েছিল, এটা তো এক ইহুদীর জানাযা। তিনি এরশাদ করেছিলেন, সে কি একজন মানুষ নয়? (বুখারী কিতাবুল জানায়েয, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত, হাদীস নম্বর ১২৩৪)

ঘোরতর শত্রু কাফের ইহুদীর লাশের প্রতিও আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্মান প্রদর্শন করে ধর্মীয় সম্প্রীতির যে অনুপম দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন তা অতুলনীয়। শুধু তা-ই নয় তাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত সাহাবীরাও একই আচরণ করে দেখিয়েছেন।

আসলে কে কোন ধর্মের বা ফেরকার অনুসারী তা মূল বিষয় নয়, বিষয় হল আমরা সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই এক জাতি। আমার ধর্মের সাথে, আমার মতের সাথে আরেক জন একমত নাও হতে পারে, তাই বলে কি তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক মারমুখি হবে? অবশ্যই না।

Advertisement

ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই।

গত ৫ আগস্ট পঞ্চগড়ে আবারো আহমদিয়া সদস্যদের ওপর যে অত্যাচার করা হয়েছে তা কখনই ধর্মের শিক্ষা হতে পারেনা। পঞ্চগড় শহরতলীতে অবস্থিত আহমদনগর ও শালশিড়ি গ্রামদুটি আহমদিয়া জামাতের সদস্য অধ্যুষিত। আহমদিসহ অত্র এলাকার সকল ধর্মমতের জনগণ এখানে দীর্ঘকাল যাবত শান্তি ও সম্প্রীতিতে বসবাস করে আসছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, গত কয়েক বছর ধরে এই শান্তির জনপদে অশান্তি সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হচ্ছে। যেখানে বিগত ৭২ বছর যাবত কাদিয়ানি বা আহমদিয়া কোন ইস্যুই ছিলো না সেখানে হঠাৎ করে এই ইস্যু তুলে এলাকায় অশান্তি করে এবং জনমনে আতংক সৃষ্টি করা হয়েছে।

যারা সামাজিক পরিমন্ডলে বিশৃংখলা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, রক্তপাত ঘটায়, ধ্বংস যজ্ঞ এবং নৈতিকতা বর্জিত অনৈইসলামিক কর্মকাণ্ড চালায় তারা মোটেও শান্তিকামী মানুষ হতে পারে না। পবিত্র কুরআনের সুরা আল বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো বল প্রয়োগ নেই। কারণ সৎ পথ ও ভ্রান্তি উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে; সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে (পুণ্যের পথে বাধা সৃষ্টিকারী বিদ্রোহী শক্তিকে) অস্বীকার করে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, সে নিশ্চয়ই এমন এক সুদৃঢ় মজবুত করে ধরেছে, যা কখনো ভাঙ্গবার নয়।’

দেশে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টান্তই আমরা লক্ষ্য করে আসছি। আমরা আশা করব এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। সম্প্রীতির চিরায়ত সেই বন্ধন ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠি সবার মাঝে অটুট থাকবে আর দেশ এগিয়ে যাক নতুন উদ্যমে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।masumon83@yahoo.com

এইচআর/এমএস