অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম থেকে এখন দেশের অভিভাবক তিনি।
Advertisement
ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প সারা বিশ্বের মডেল। তার সামাজিক ব্যবসা ধারণাটি বহির্বিশ্বে অনুকরণীয়। ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এবার হলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান।
জন্ম ও বেড়ে ওঠামুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর কাপ্তাই সড়কের বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার বাবা হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ছিলেন একজন জহুরি। মা সুফিয়া খাতুন। ১৯৪৪ সালে গ্রাম থেকে মা-বাবার সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন।
শিক্ষা জীবনলামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মুহাম্মদ ইউনূস মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। এরপর ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন।
Advertisement
পড়াশোনা শেষে তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিক্সে যোগ দেন গবেষণা সহকারী হিসেবে। পরবর্তীসময়ে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। পরে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই ১৯৭৬ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।
উল্লেখযোগ্য অর্জন ও পুরস্কারগ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প দারিদ্র্য বিমোচনে কৃতকর্মের জন্য ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয় করেন ড. ইউনূস। তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকসহ প্রায় ১৪৫টি পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পান। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম এবং ২০১০ সালে কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পান। ২০২০ সালে তিনি ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি থেকে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।
আরও পড়ুনযারা আছেন অন্তর্বর্তী সরকারেসমন্বয়ক থেকে অন্তর্বর্তী সরকারে নাহিদ ও আসিফসন্তানেরা ময়লা পরিষ্কার করছে, নোংরা করবেন নাসবশেষ আজারবাইজানের বাকুতে ২০২৪ সালের ১৪-১৬ মার্চ একাদশ বিশ্ব বাকু ফোরামে তাকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘দ্য ট্রি অব পিস’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
Advertisement
জীবন সংগ্রামে ড. ইউনূসদরিদ্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রামটা শুরু ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময়। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে মুহাম্মদ ইউনূস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন, যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে উদ্ভাবকদের সহায়তার জন্য ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ ধারণা ‘ইনফো লেডি সোশ্যাল এন্টারপ্রেনারশিপ’ প্রোগ্রামের মতো কর্মসূচিকে অনুপ্রাণিত করে।
যেভাবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও নোবেল জয়ড. ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকা অবস্থায় বিভাগে কাজের পাশাপাশি আশপাশের গ্রামে ঘুরতেন। জোবরা ও সংলগ্ন গ্রামগুলোতে শুরু করেছিলেন একটি মাঠ গবেষণা, যেখানে তিনি যাচাই করতে চেয়েছিলেন সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষের মধ্যে ব্যাংকঋণ সরবরাহের সম্ভাব্যতা। সেখানে শুরুতে তেভাগা পদ্ধতি কৃষকদের খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমের কার্যক্রম শুরু করেন অধ্যাপক ইউনূস। যার নাম ছিল নবযুগ তেভাগা খামার। জমি যার সে ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে। আর যে বীজ দেবে সার দেবে সে পাবে এক ভাগ। আর চাষ করবে, পানি দেবে সে পাবে এক ভাগ।
পরে গ্রামের অবহেলিত নারী ও পুরুষদের নিয়ে একটা সমিতি শুরু করেন। সেই সমিতিতে সঞ্চয় করতো সবাই। এই কৃষকদের খামার থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তি রচিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। পরবর্তীতে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা নিয়ে বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম হয় গ্রামীণ ব্যাংকের। এরপর অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এ কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করলে ২০০৬ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন অধ্যাপক ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পুরস্কার লাভ করেন।
আলোচিত ‘সামাজিক ব্যবসা’ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা বা Social Business ধারণাটি শুরু হয় সেই জোবরা গ্রাম থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকাকালীন তার তেভাগা পদ্ধতিতে চাষাবাদ এখন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সামাজিক ব্যবসা হিসেবে পরিচিত। সামাজিক ব্যবসার এ ধারণাটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে এবং সে লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্ভীক ও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও তার জন্মদিন ২৮ জুন ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর সামাজিক ব্যবসা দিবস বা Social Business Day হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিনটি পালন করার সার্বিক দায়িত্বে আছে ইউনূস সেন্টার।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে ড. ইউনূসড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
ড. ইউনূসের আলোচিত গ্রন্থব্যাংকার টু দ্য পুওর: মাইক্রো ল্যান্ডিং অ্যান্ড দ্য ব্যাটল এগেইনস্ট ওয়ার্ল্ড প্রোভার্টি।ক্রিয়েটুং এ ওয়ার্ল্ড উইদাউট প্রোভার্টি: সোশ্যাল বিজনেস অ্যান্ড দ্য ফিউচার অব ক্যাপিটালিজম।
আরএএস/এএসএ/জেআইএম