বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার বিদায়ে জয়োল্লাসে মাতে দেশ। সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্তরা বিনষ্ট করেছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা অস্থিতিশীল। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) শপথ নিতে যাচ্ছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার গভীর পর্যবেক্ষণে রয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক দেশে আমদানি-রপ্তানিসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগও রয়েছে। ফলে তাদের সূক্ষ্ম নজর রয়েছে বাংলাদেশের দিকে। যে কোনো ধরনের পরিস্থিতির জন্য তারা সব সময় সজাগ।
সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত মোফাজ্জল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখছেন। সবাই কিন্তু নিজের স্বার্থ রক্ষা করে কথা বলে। কূটনীতিবিদের কাজই হচ্ছে যতই বড় সমস্যাই হোক সেগুলো হ্যান্ডেল করতে হবে নিজের দেশের স্বার্থ রক্ষা করে।’
তারা চাইবে এখানে স্থিতিশীলতা আসুক। তাদের ভবিষ্যৎ রূপরেখাও তাদের নির্ণয় করতে হবে। সেজন্য আমার মনে হয় যত তাড়াতাড়ি সরকার হয় এবং তারা কী ভূমিকা পালন করে সেটির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।- অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন
Advertisement
‘আমার ধারণা আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তখন বা তারও আগে নবগঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকার এখানে যে সব বিদেশি রাষ্ট্রদূত আছেন তাদের একটি ব্রিফ করতে হবে। তখন তারা ঢাকায় থেকে যে পরিস্থিতি দেখছেন আর সরকারে কী হচ্ছে বা কোন পথে যাচ্ছে সেগুলো নিয়ে তাদের দেশে বার্তা দেবেন।’
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ ও জাতিসংঘসহ কয়েকটি সংস্থা এরই মধ্যে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্র-জনতার এ বিজয়কে স্বাগত জানিয়ে পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের কথা বলেছেন। তবে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি প্রতিবেশী দেশ ভারত।
আরও পড়ুন পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায় বাংলাদেশি কূটনীতিকরা দেশে যে সহিংসতা হচ্ছে সেগুলো ষড়যন্ত্র: ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্রশেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা ও সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এক বিবৃতিতে ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, ‘মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের উত্তরণ নিশ্চিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ইইউ।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিয়মতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের উত্তরণ নিশ্চিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জনগণের নিবেদিত অংশীদার হিসেবে ইইউ বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
Advertisement
রক্তক্ষয়ী ছাত্র আন্দোলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে স্যালুট জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। গত কয়েক সপ্তাহে অনেক প্রাণ ঝরেছে। আমরা সামনের দিনগুলোতে শান্তি ও সংযমের আহ্বান জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যে কোনো পরিবর্তন পরিচালনার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা চাই, বাংলাদেশের জনগণই ভবিষ্যৎ সরকারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিক।’
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে যুক্তরাজ্য। দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের একজন মুখপাত্র এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র লন্ডনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিগত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে আমরা যে সহিংসতা দেখেছি, তাতে প্রধানমন্ত্রী স্টারমার গভীরভাবে শোকাহত। আমি আশা করি, (বাংলাদেশের) গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য এবং বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার ও শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনসহ বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, জাতিসংঘ সব পক্ষকে শান্ত ও সংযমে থাকার জন্য অনুরোধ করেছে এবং একটি শান্তিপূর্ণ সুশৃঙ্খল ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে। ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্য শহরে যারা রাস্তায় বের হচ্ছে তাদের রক্ষা করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অনুরোধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ দ্রুত রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ফিরবে বলে প্রত্যাশা রাশিয়ার। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ঢাকায় দেশটির দূতাবাস এক বিবৃতিতে এ অভিমত জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাইয়ের সরকারবিরোধী ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় নিহত দায়ীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভা পদত্যাগের খবর বাংলাদেশি গণমাধ্যম জানিয়েছে।
‘দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। শিগগির অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে যে কোনো পরিবর্তন হলেও মস্কো যে ভিত্তির ওপর কাজ করে সেটা হলো, তা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে আশা করি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাংবিধানিক নিয়মে ফিরে আসে।’
বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছে চীন। শিগগির বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরবে বলে আশা করছে দেশটি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে চীন। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী ও কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীন আন্তরিকভাবে আশা করছে, দেশটির সমাজে খুব শিগগিরই স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদেশিরা তো আমাদের অবজারভেশনে রাখবেই। তাদেরও তো এখানে অনেক বিনিয়োগ আছে। এতগুলো প্রাণ গেছে, এখানে মানবাধিকারের বিষয়গুলো আসবে। আমরা জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, আমরা শান্তিরক্ষা মিশনে লোক পাঠাই। তাই সবকিছু তো তারা অবজারভেশনে রাখবে।’
‘তারা চাইবে এখানে স্থিতিশীলতা আসুক। তাদের ভবিষ্যৎ রূপরেখাও তাদের নির্ণয় করতে হবে। সেজন্য আমার মনে হয় যত তাড়াতাড়ি সরকার হয় এবং তারা কী ভূমিকা পালন করে সেটির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।’
তিনি বলেন, ‘যত দিন পর্যন্ত একটি স্থিতিশীলতা ফেরত না আসে ততদিন তারা অবজারভেশনে রাখবেই। আস্থাহীনতার জায়গা তো তৈরি হয়ে গেছে। জনগণের সঙ্গে সরকারের যে বিচ্ছিন্নতা এটা তো আমরা বহুদিন ধরে বলছিলাম। বাংলাদেশে এখনো তো অনেক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। এখানে তৃতীয় পক্ষ যেন সুযোগ না নেয় সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
আইএইচআর/এএসএ/জিকেএস