সময়টা বড় অস্থির। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন। না, এটা কোনো দলীয় বা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন নয়। ছাত্রদের হাত ধরে দেশে এক নয়া আন্দোলনের সফল। যে কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশে সব সময় সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত আসে। এটা ইতিহাস থেকে জানা যায়। স্বাধীনতা সময়কাল থেকে শুরু করে এ দেশে যতবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে প্রত্যেকবারেই সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়েছে। এটা যে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়েছে এমনটি নয়। সময় এবং দেশ ভেদে এই নির্যাতিত হয়ে আসছে। এক দেশে যে সম্প্রদায় সংখ্যালঘু, অন্য দেশে সেই সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু। কখনো ধর্মভিত্তিক হয়ে থাকে, কখনো বর্ণ ভিক্তিক হয়ে থাকে কখনো বা লিঙ্গভিত্তিক হয়ে থাকে। সব দেশে সব সময় সংখ্যালঘু ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
Advertisement
১৯৪৭ সালে অখন্ড ভারত শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। এ সময় প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুৎ হয়েছিল। প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রান হারিয়েছিল। এই বছরই প্রথম তৎকালিন পূর্ব বাংলার হিন্দুরা নিজের বাস্তু-ভিটা ফেলে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে চলে যায়। নিজের চৌদ্দপুরুষের ভিটে-মাটি ফেলে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যায়। তবে কথা থেকে যায়, সবাইকি চলে গিয়েছিল? না, সাবই যায়নি।
প্রতিটি দেশে, প্রতিটি সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা কখনো সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে না। তারা সমস্যাকে ভয় পায়। শত্রুকে প্রতিহত করতে ভয় পাওয়া কিছু মানুষ তখন পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী হয়ে যায়। এরা অচেনা দেশে নিজের শেকড় গাঢ়তে শুরু করে। কিন্তু আসল শেকড় রয়ে যায় পূর্ববাংলায়। কারো ভাই, কারো বোন কারো আত্মীয়-স্বজন রয়ে যায় পূর্ববাংলায়। সময়ের প্রয়োজনে ক্ষত শুকিয়ে যায় পূর্ববাংলার মানুষের। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় নতুন শেকড় গজানোর অপেক্ষারত পরিবারগুলোর ক্ষত শুকোয় না। তারা একবুক হাহাকার নিয়ে পূর্ব বাংলার সৌন্দর্য্য আর সুখে কাটানো স্মৃতি রোমন্থন করে কেবলই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আরো একবার পূর্ব বাংলার হিন্দুরা ঘর বাড়ি ফেলে দেশ ছাড়ে। এবারও গন্তব্য পশ্চিমবাংলা। পূর্বে চলে যাওয়া মানুষগুলোর কাছেপিঠে আশ্রয় হয় এসময়ে ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর। দীর্ঘশ্বাসের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের আদি জনবসতি অর্থাৎ হিন্দুস্থানী বা ঘটিদের কাছে এরা কেবলই বাঙাল হিসেবে গালি খেতে থাকে। কারণ সদ্য উদ্বাস্তু বাঙালদের তখন অভাবে দিন কাটে। এছাড়া ঘটি এবং বাঙালদের জীবন প্রণালীতে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ধর্মীয় উৎসব থেকে শুরু করে খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি সবেতেই রয়েছে পার্থক্য।
Advertisement
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ববাংলা থেকে প্রায় ১ কোটি শরণার্থী আশ্রয় নেয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। যুদ্ধচলাকালীন ৯ মাস তারা সেখানে আশ্রয় নেয়। তবে ভারত সরকারের আহ্বানে অনেকেই তখন সে দেশে স্থায়ীভাবে রয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরদিন থেকে অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। শুধু তা-ই নয়। প্রত্যেক নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে এ দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে হিন্দুরা দেশ ছেড়েছে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে হিন্দুদের একটা কথাই বলেছে, তা হলো মুসলিমদের অত্যাচার। এ দেশে যে সরকারই আসুক না কেন, তারা হিন্দু ভোটগুলো নিয়ে সবসময় হিসাব কষে। কারণ স্বাধীনতা পরবর্তীতে এ দেশে বসবাসরত প্রায় সকল হিন্দু জন্মগত আওয়ামীলীগ করে। এটা অবশ্য এদেশে বসবাসরত মুসলমানদের ধারণা। সুকৌশলে এই ধারণা সকলের মনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। যার কারণে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসলে ধারণা করা হতো, তারা কোনো হিন্দুদের ভোট পায়নি। বিএনপি আসলেও ধারণা করতো তারা ভোট পায়নি। সুতরাং প্রত্যেক বারেই নির্যাতিত হয়েছে হিন্দুরা। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দুদের। তাদের উপর নির্যাতন করে দোষ চাপানো হয়েছে অন্য দলগুলোর উপর।
গত ৫ আগস্টের পর দেশের প্রথম পরিবর্তন আনা হয়েছে হিন্দুদের মন্দির-ঘরবাড়ি ভাঙা, আগুন দেয়া, লুট করা দিয়ে। মসজিদে মাইকিং করে হুজুররা এলাকার সকলকে আহ্বান জানিয়েছে সংখ্যালঘুদের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে। তারা গ্রুপে গ্রুপে পাহারাও দিয়েছে। তাহলে হিন্দুদের উপর নির্যাতন করলো কারা, এমন প্রশ্ন থেকে যায়।
ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ, বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য আপনাদের ভাবতে হবে না। এ দেশে বসবাস করা হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এ দেশের বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। এদেশে শান্তিতে বসবাস করা হিন্দুদের মৌলিক অধিকার। এটা তাদের চৌদ্দপুরুষের ভিটা। কোথাও থেকে উড়ে আসেনি। আর কেউ বললেই দেশ ছেড়ে রাতের অন্ধকারে চলেও যাবে না।
Advertisement
বাংলাদেশে বসবাস করা অনেক হিন্দু পরিবার আছে, যারা মুসলমানদের সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করছে। তাদের অনেকের ঘটনা থেকে জেনেছি বা দেখেছি, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, অথবা শরীকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকার কারণে শত্রুতার জের ধরে নিজের বসতবাড়ি চুপি চুপি মুসলমানদের কাছে বিক্রি করেছে। ওই পরিবার চলে যাবার পরদিন মুসলমান পরিবার তার জিনিসপত্র নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে হিন্দু পরিবারটির পাশের ঘরে বসবাস করার জন্য। এখানে দোষটা কার?
আমার এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত। এখানে কোনো মুসলমানের বসবাস নেই। কিন্তু যতবার বাড়ি যাই, প্রত্যেক বারেই শুনি কোনো না কোনো পরিবার ভারতে চলে গিয়েছে। কারণ জানতে চাইলে বলে, এদেশে থাকা যাবে না। আমি জানতে চাইলাম, অন্যান্য এলকায় তো মুসলমান থাকে বলেই তাদের অত্যাচারে হিন্দুরা দেশ ছাড়ে। কিন্তু তোমরা কেন ছাড়ছো। এখানে কোন স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, হাট, বাজার কোথাও মুসলমান নেই। তাহলে কিসের ভয়ে, কার অত্যাচারে তোমরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছো?
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একবার একজনের বাড়িতে গিয়েছি। গিয়ে দেখি তার পাশের ঘরটি এক মুসলমান পরিবারের। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশ থেকে মুসলমানের ভয়ে চলে আসলে। কিন্তু এখানে এসে তো পাশাপাশি ঘরে বাস করছো। এখন ভয় করে না?
প্রত্যেকবার কোলকাতা গেলে যার সাথে দেখা হয়, প্রথমেই জিজ্ঞেস করে ওদেশের অবস্থা কি? আমি সবসময়ই বলি আমরা ভালো আছি। তোমাদের মতো অন্তত বাঙাল হিসেবে গালি খেতে হয় না। এই যে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করার অর্থ হলো বাংলাদেশের হিন্দুরা কেউ ভালো নেই। এসব অতি দরদী পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের বলতে চাই, আপনারা নিজের সুখের কথা চিন্তা করে এ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা যারা এদেশে নির্যাতিহ বা উল্লাসে যেভাবেই হোক না কেন, আছি তো! দেশকে ভুলে অন্যদেশে চলে যাইনি। আপনাদের মতো অতটা স্বার্থপর আমরা নই। দেশের দুর্দিনে দেশকে ফেলে, দেশের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন ফেলে নিজের সুখের কথা চিন্তা করে চলে যাইনি।
প্রত্যেক দেশেই সমস্যা আছে। পাকিস্তানে এখনো হিন্দুদের বসবাস আছে। তাদের সঙ্গেও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তাই বলে তারা বাংলাদেশে বা ভারতে চলে যায় না। আবার ভারতে সংখ্যালঘু মুসলামান। তাদের ওপরেও অনেক ধরনের নির্যাতন হয়। তারাও কখনো বলে না দেশ ছেড়ে চলে যাবে। তবে বাংলদেশ ব্যতিক্রম। এর কারণ হিসেবে আমি অনেক গবেষণা করেছি। যা পেলাম তা হলো, পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকরা পূর্বপুরুষদের অতি দরদ।
বাংলাদেশের হিন্দুদের যদি কথায় কথায় পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবার সুযোগ না থাকতো, তাহলে তারা যেতো না। আর এদেশের মুসলমানরাও তাদের কথায় কথায় বলতো না ভারতে চলে যাও। বাংলাদেশের হিন্দুদের ভারত প্রীতির কারণে এ দেশের মুসলমানদের মনে এখনো ঠিক মতো পোক্ত হয়নি, হিন্দুরা এ দেশেরই নাগরিক। আর হিন্দুরাও নিজেদের রক্ষা করতে শেখেনি। ভারতে স্থায়ী হবার রাস্তা যদি না থাকতো, তাহলে এ দেশে হিন্দুশূন্য হতো না। বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুদের কারণে আমরা এ দেশে সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হয়েছি।
ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ, বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য আপনাদের ভাবতে হবে না। এ দেশে বসবাস করা হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এ দেশের বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। এদেশে শান্তিতে বসবাস করা হিন্দুদের মৌলিক অধিকার। এটা তাদের চৌদ্দপুরুষের ভিটা। কোথাও থেকে উড়ে আসেনি। আর কেউ বললেই দেশ ছেড়ে রাতের অন্ধকারে চলেও যাবে না। তাই এদেশে বসবাস করা হিন্দুদের বলছি, চলে যাবার অপশন আজ থেকে বন্ধ করুন। এ দেশটাকে নিজের করে ভাবতে শিখুন। মনে রাখবেন এ দেশ আমার-আপনার-আমাদের সকলের। এ দেশে প্রতিবেশির সুখ-শান্তি এবং সুরক্ষা বজায় রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
লেখক: সাংবাদিক, নাট্যকার।
এইচআর/জেআইএম