বিশেষ প্রতিবেদন

পার্বত্য চট্টগ্রামে মৎস্য চাষ প্রকল্পে লোপাট চলছে

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। ঘটছে পুকুর চুরি কাণ্ড। সরেজমিন তদন্তসহ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য।জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রায় ৮০ কোটি টাকা পার্বত্য তিনটি জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে পাহাড়ি ঘোনা ও ঝিরিতে ক্রিকবাঁধ দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সরকার। বর্তমানে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে কাজ বাস্তবায়ন চলছে। কিন্তু দশ বছর আগে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হতে পারেনি। সূত্র মতে, ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের প্রথম পর্যায় বাস্তবায়িত হয় ২০০৫-০৭ অর্থ সালের মেয়াদে। এরপর ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় পর্যায় কাজ চলে ২০০৮-১২ অর্থ সালের মেয়াদে। বর্তমানে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির তৃতীয় পর্যায় ২০১২-১৭ মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার মোট ২৫টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বিভাগ। প্রকল্পের প্রধান কার্যালয় রাঙামাটি জেলা মৎস্য বিভাগ ভবনে।অনুসন্ধানে জানা যায়, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পার্বত্য তিন জেলায় পাহাড়ি ঘোনা ও ঝিরির ওপর ক্রিকবাঁধ নির্মাণ করে প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পটির নাম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎসচাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প’ বর্তমানে যার তৃতীয় পর্যায় বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। পুকুর আর জলাশয়ের স্বল্পতার কারণে পিছিয়ে থাকা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনমান উন্নয়নে পার্বত্য জেলাগুলোতে মৎস্যচাষ কার্যক্রম ও উৎপাদন বাড়িয়ে স্থানীয় জনগণের আয় ও পুষ্টির জোগান দেয়াই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এদিকে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১২ সালের জুুলাই মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পটির তৃতীয় পর্যায় শেষ হচ্ছে আগামী ২০১৭ সালের জুনে। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রায় ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের মাধ্যমে নির্মিত ৮২৮টি ক্রিক বাঁধের মাধ্যমে সৃষ্ট ৮৬৩ হেক্টর জলাশয়ে প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার ৭০৬ মেট্টিন টন মাছ উৎপাদনের কথা থাকলেও সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তো দূরের কথা এর ৭৫ ভাগ জলাশয় এখন অকেজো, পরিত্যক্ত ও মাছ উৎপাদনহীন। অথচ লক্ষ্য ছিল এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কাপ্তাই হ্রদের মতো এইসব ক্রিকের মাধ্যমে সৃষ্ট জলাশয়েও চাষ হবে রুই জাতীয় এবং তেলাপিয়া মাছ। কিন্তু কীভাবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পটি। শুধু মাছ চাষে ব্যর্থতা নয়- এই প্রকল্পের মাছ চাষের পাশাপাশি সেচ ও গৃহস্থালী কাজে পানি ব্যবহার, ক্রিকের পাড়ে শাক-সবজী চাষ, সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহার এবং সর্বোপরি পানির রিজার্ভার হিসেবে ব্যবহারের বিষয়গুলোতেও আসেনি প্রত্যাশিত সফলতা। অনুসন্ধানকালে সরেজমিন ক্রিকগুলোর যে বেহাল অবস্থা দেখা গেছে তা যেন অনিয়মের এক বিরল দৃষ্টান্ত। মৎস্য চাষ প্রকল্পের অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে ক্ষুদ্ধ পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো এবং পার্বত্য বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীও। এমনকি কোথায় কোন প্রকল্প নেয়া হয় সেসব কিছুই জানেন না সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যানরা।৩০ মার্চ রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভায় পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, খাগড়াছড়ির  সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা এই প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, এই প্রকল্প কর্মকর্তা এত বড় মাপের অফিসার যে, তাকে টেলিফোনেও পাওয়া দুষ্কর। তিনি ইচ্ছেমাফিক প্রকল্পের বিভিন্ন টেন্ডার আহ্বান করেন। প্রকল্পের কাজের বিষয়ে তিনি সংসদ সদস্য কিংবা জেলা পরিষদ কাউকে কিছু অবহিত করেন না। প্রতিটি ক্ষেত্রে এই প্রকল্প কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা দৃশ্যমান। সংসদ সদস্যদ্বয় এই কর্মকর্তাকেও প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করার দাবি জানান। এর জবাবে সংসদীয় কমিটি অবিলম্বে তাকে কর্মস্থল থেকে বদলি করাসহ তার বিরুদ্ধে সরকারি চাকরির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করেন।অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্যচাষ ও সম্প্রসারণ প্রকল্প (তৃতীয়) পর্যায়ের কাজ চলমান রয়েছে। যদিও প্রকল্পের অধিকাংশ কাজই বর্তমানে শেষ পর্যায়ে আছে- এর আগের দুই পর্যায়ে তেমন বড় কোনো কাজ না হলেও এবার তৃতীয় পর্যায়েই সবচে বেশি ক্রিক নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু কাজের শুরুতেই দেখা দেয় দুর্নীতি আর অনিয়মের নানা কর্মকাণ্ড। বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে রাজনৈতিক সুপারিশ আর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নির্বাচন করা হয় যেনতেন জায়গায় প্রকল্পের স্থান। যা ভৌগোলিক কারণে এবং বাস্তবতার নিরিখে প্রকল্পের সফলতার জন্য বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এরপর টেন্ডার প্রক্রিয়াতেও বিরাট গলদ। টেন্ডার জমা না নিয়ে বাছাই করা হয় গোপনে এবং নিজেদের ইচ্ছে মাফিক।অভিযোগে জানা যায়, প্রকল্পের পরিচালকের ‘খাসলোক’ জামাল ঠিকাদারদের মাঝে কাজ দেন যেনতেনভাবে কাজ করার শর্তে সাড়ে ১১ ভাগ পার্সেন্টেজের বিনিময়ে। এতে রয়েছে প্রকল্প পরিচালক, হিসাব রক্ষক এবং মূল অফিসের খরচ। এরপর শুরু হয় ক্রিক নির্মাণ কাজ। এরপর কাজের মনিটরিংয়ের জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে ৫ ভাগ, কাজ তত্ত্বাবধানকারী মৎস্য বিভাগের প্রকৌশলীকে ৫ ভাগ, অন্যান্য চাঁদা ৭ ভাগ, কাজের সিকিউরিটি জামানত ১০ ভাগ এবং উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কিংবা প্রকৌশলী যতবারই ক্রিকের কাজ পরিদর্শন করতে যান ততবারই ঠিকাদারকে বহন করতে হয় যাতায়াত, আপ্যায়ন, উপঢৌকনসহ সব খরচ। ফলে শেষ পর্যন্ত কাজটির গুণগত মান আর থাকে না। এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে অন্তত: দুইটি ক্রিক নির্মাণে জড়িত থাকা সৈকত চৌধুরী বলেন, আমি টুকটাক ঠিকাদারি কাজ করি বিভিন্ন বিভাগে। কিন্তু এই প্রকল্পে মৎস্য উন্নয়নের নামে ক্রিক নির্মাণের মধ্য দিয়ে যে নজিরবিহীন অনিয়ম আর দুর্নীতির চিত্র দেখেছি তাতে আমি নিজেই হতাশ।  কারণ এখানে নানাভাবে অফিস খরচ, চাঁদা এবং সিকিউরিটি মানি রাখার পর অর্ধেকেরও কম টাকা বাকি থাকে- যা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হয়। আর এমন স্থানে প্রকল্প নির্বাচন করা হয়- সেখানে হাজার কোটি টাকা খরচ করেও যে মৎস্য চাষ সম্ভব নয়- এটা জানা বা বোঝার জন্য মৎস্য বিজ্ঞানী হওয়ারও দরকার নাই। যে প্রকল্পের কাজের ওয়ার্ক অর্ডার হাতে পেতেই ৫ ভাগ টাকা দিতে হয় সেখানে কাজের কাজ আর কী থাকে। অভিযোগ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. হান্নান মিয়া বলেন, এসব প্রমাণহীন অভিযোগের তোয়াক্কা করি না। সংসদীয় কমিটিও ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। তিনি বলেন, আমার মন্ত্রণালয় ঠিক থাকলেই হল। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সংসদীয় কমিটির আমার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার কথা উদ্দেশ্যমূলক। আমি এক টাকার দুর্নীতিও করিনি। কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। আমি ঠিকাদারদের কাছ থেকেও কোনো টাকা নেইনি। হান্নান মিয়ার ঘনিষ্ট হিসেবে অভিযুক্ত এমএলএসএস জামাল সাড়ে ১১ ভাগ টাকা পার্সেন্টেস নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, আমি ট্রেজারির কাজের জন্য দশমিক পাঁচ ভাগ টাকা নিয়েছি- এটা সত্য। কিন্তু তার বাইরে অফিসের খরচের কথা বলে কোনো টাকা নেইনি। ১১ ভাগ টাকা পার্সেন্টেস নিয়ে অভিযোগ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। এটা আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত। এ ব্যাপারে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা বলেন, মৎস্য বিভাগ জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত একটি বিভাগ। অথচ ওই প্রকল্পের পরিচালক আমার কোনো কথাই শোনেন না। তিনি আমার ফোনও ধরেন না। তার উদ্ধ্যতপূর্ণ আচরণ এবং সীমাহীন দুর্নীতি সম্পর্কে সংসদীয় কমিটির সভায় বলেছি। শুধু আমি নই- পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী এবং খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরাও বলেছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় কমিটি তাকে শাস্তিমূলক বদলির সুপারিশ করেছে।একে/পিআর

Advertisement