দেশজুড়ে

সেদিন প্রাণভিক্ষা চেয়েও বাঁচেননি ১৪ পুলিশ সদস্য

‘আমরা হামলাকারীদের ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম। পুলিশও ভয়ে পালিয়েছিল। এরই একপর্যায়ে হামলাকারীরা বাথরুমে ঢুকে কয়েকজন পুলিশ সদস্যদের টেনেহিঁচড়ে বের করে। আমার বাড়ির উঠানের মধ্যেই তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। পুলিশ সদস্যরা প্রাণভিক্ষাও চেয়েছিলেন, তারপরও ওইদিন ১৩ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন আরও একজন হাসপাতালে মারা যান।’

Advertisement

গত রোববার (৪ আগস্ট) সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ঘটে যাওয়া এমন রোমহর্ষক বর্ণনা দেন এনায়েতপুর গ্রামের বৃদ্ধ বাবু প্রামাণিক (৭০)। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকালে তিনি জাগো নিউজকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

বাবু প্রামাণিক আরও জানান, ওইদিন থানা এলাকায় হামলা, গুলির শব্দ চলে দুপুর একটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত। পাঁচ থেকে ছয়জন পুলিশ সদস্য থানার পেছন দিয়ে দৌড়ে তার বাড়ির ভেতর ঢুকে আশ্রয় নেন। পরে তারা দৌড়ে বাড়ির পেছনে থাকা একটি পাকা বাথরুমের মধ্যে ঢুকে পড়েন। কিন্তু হামলাকারীরা তাদের পিছু নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে খুঁজে বের করে পিটিয়ে হত্যা করে। তবে এ হত্যাকারীরা কেউই স্থানীয় নয়, সবাই ছিল অপরিচিত মুখ।

হামলায় আহত পুলিশ পরিদর্শক শাহিনুর আলম বর্তমানে সিরাজগঞ্জ শহরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি জাগো নিউজকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ওইদিন সকাল ১০টার দিকে আন্দোলনকারীরা এনায়েতপুর কেজির মোড় এলাকায় একটি বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। এরপর মিছিলটি থানার দিকে আসে। থানার সামনে এসে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এ সময় আমরা তাদের অনুরোধ করে বলতে থাকি এটি জনগণের প্রতিষ্ঠান, আমরা আপনাদের শত্রু নই, কাজেই আপনারা এখানে ইটপাটকেল নিক্ষেপ বন্ধ করুন। অন্যথায় আমরা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো। আমাদের এমন অনুরোধে তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর আবারো তারা একটি মিছিল নিয়ে এসে থানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। এসময় তাদের অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয়নি।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘পরে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা হয়। তখন তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যায়। এর বেশ কিছুক্ষণ পর দুপুর একটার দিকে আবারো একটি বড় মিছিল এসে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে থানার ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলেও লাভ হয়নি। পরে আমরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইলেও তারা চার থেকে পাঁচ হাজার লোক থানার চারপাশের এলাকা ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালায়। সে সময় আমরা সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন পুলিশ সদস্য প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করি।’

তিনি বলেন, ‘তারা থানায় প্রবেশ করেই আগুন দেয়। এ সময় থানা কার্যালয়ের নিচতলায় থাকা আমরা নয়জন পুলিশ সদস্য কৌশলে ভবনের ছাদের ওপরে গিয়ে পানির ট্যাংকের নিচে লুকিয়ে যাই। হামলাকারীরা প্রথমে থানা কার্যালয়ের নিচতলায় মূল ফটকে অগ্নিসংযোগ করায় আর ওপরে ওঠেনি। আমরা নয়জন পুলিশ সদস্য সেই পানির ট্যাংকের নিচে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করতে থাকি। এ সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার পর দীর্ঘ সময়েও কোনো উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়নি। এরপর সন্ধ্যায় সেনা সদস্যদের গাড়ির হুইসেল শুনে আমরা সেখান থেকে বের হই। তাদের কাছে সাহায্য চাইলে তারা আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। আমার সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যদের সবাই শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।’

শাহিনুর আলম জাগো নিউজকে আরও বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই থানার পেছন পাশের ভাঙা দেওয়ালের ভেতর দিয়ে বের হয়ে উত্তর পাশের বাড়িগুলোতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু হামলাকারীরা সেখান থেকে তাদের ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করে। হামলাকারীরা দুপুর ১টা থেকে বিকেল প্রায় ৪টা পর্যন্ত থানা ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করে এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। শুধু তাই নয়, থানার মধ্যে থাকা প্রতিটি আবাসিক ভবন, গাড়ি, মোটরসাইকেলসহ আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। আবাসিক ভবনে থাকা আমাদের স্ত্রী ও শিশু সন্তানরা থানার পেছনের কয়েকটি বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ায় প্রাণে বেঁচে আছেন।’

এফএ/জেআইএম

Advertisement