সাহিত্য

মামুন রশীদ: ঘোরলাগা এক কবিতা বলয়

নুরুন্নাহার মুন্নি

Advertisement

অন্তরে প্রেম আর জাগতিক ধ্যান আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষ প্রেমের সঞ্জীবনী শক্তি নিয়েই বাঁচে, বাঁচতে চায়, বাঁচতে চাইবে—এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এই সহজাত প্রবৃত্তিকেই যিনি সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং উপলব্ধিতে ঢেলে সাজিয়েছেন কবিতার আরণ্যক ভুবন, তিনি হলেন কবি মামুন রশীদ। একবিংশ শতকের প্রথম বা শূন্য দশকের সৌন্দর্যবোধ তার উপমার গাঁথুনিতে তৈরি করেছে কবিতার ইমারত, নিপুণ সাম্রাজ্য। আর প্রেম সে যেন আবেগের অতিরঞ্জন হয়ে মিশে গেছে পঙক্তির পললে। কখনো প্রেমের মায়াজালে পাঠককে অন্ধকার থেকে তুলে আনতে জ্বেলেছেন হ্যাজাকের আলো। কখনোবা ঘরের ভেতর থেকে তৈরি করেছেন সাঁকো বানানোর কৌশল। কবি মামুন রশীদ ভেতরের কথা, হৃদয়ের তোড়ন, সময়-অসময়ে ভালো লাগা, তৃপ্তি-অতৃপ্তি, প্রকৃতির প্রেমদানে সন্তুষ্টি কিংবা সুদূর প্রসারী চিন্তায় সুপ্ত লালনের বাস অথবা বাহির জগত থেকে অর্ন্তজগতে সমাজের ভালো-মন্দের পসরা খুলে বসেছেন তিনি কবিতার আদলে জীবনের পৃষ্ঠায়। বৈশ্বিক সমাজ-সংস্কৃতির একজন চিন্তাশীল এবং জীবনমুখী চেতনার বোহেমিয়ান ভাবনার সমৃদ্ধজন কবি মামুন রশীদ পাঠক হৃদয়ে কাঁপন তোলেন। নিজ গুণে আসন পেতে নেন, তা এমনি এমনি তো নয়! নিজের হয়ে পাঠকের কথা কবিতার গলিতে ছড়িয়ে দেন আর তা স্বাচ্ছন্দ্যে তুলে নেয় পাঠক স্বমহিমায়। মনের অতশি কাঁচ দিয়ে প্রবেশ করেছেন সমাজের শ্রেণি বিবেধের তলানি পর্যন্ত, মানুষের কান্না, হতাশা আর দুঃখবোধ তার আর্তি হয়ে বিচরণ করেছে কবিতায়। তিনি লিখেছেন, ‘মন ছাড়া গোপন কোন ক্যামেরা নেই আমার/ শ্মশান আর নদীর মধ্যে রয়েছে যেমন যোগসূত্র/ অভিমান; নিঃসঙ্গ পানপাত্রের মতো/ ঘুমন্ত শহরকে আমি জাগতে দেখলাম/ ঘুমন্ত শহর আর ঘুমন্ত মানুষের মধ্যে/ ঠিকানা আর পোষা হাওয়া বদল হলে/ কে যেন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে/ অতিথি নিবাসগুলোর ধরন এক হলেও/ প্রকৃতি নিয়ম বুঝে, মানুষ বোঝে দৃশ্য।’

এমনিভাবে বলেছেন জীবনের কথা, মানুষের কথা, সম্পর্কের হইহুল্লোড় আর উত্থান-পতনের কথা, জীবন ঘনিষ্ঠ ছায়াহীন মাঠে অনালোচিত চিন্তার উজ্জ্বল অংশ পুড়িয়ে লিখেছেন হৃদ-যন্ত্রণার পোড়া কবিতা, কী দুর্দান্ত মোটিভেশন! লিখেছেন, ‘পুড়ছি আমি যে নিপুণ পুড়ছি এই শোকাবহ করুণ/ রোদন তোমাকে কাঁপিয়ে দেয় না/ ভাঙছি আমি যে আহত আর্তনাদে ভেঙে যাচ্ছি/ এই শঙ্কার সমগ্রতা তোমাকে ভয় পাইয়ে দেয় না।’ নির্মেদ, সরল এবং জ্ঞানগর্ভ শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা নিয়ে কবিতায় বই টুবানি খেলা খেলেছেন পরম যত্নে। এক ঝলকে কবিতার গভীরে ঢুকে যেতে কিংবা ভাষা বুঝতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয় না, এমনই তার কবিতার সৃজন। কবি মামুন রশীদের কবিতায় বাস্তবতা-পরাবাস্তবতা যেমন স্থান পেয়েছে; তেমনই কখনো কখনো তিনি হয়ে উঠেছেন কল্পনার আজ্ঞাবহ দাস। তার ইচ্ছেডানায় ভর করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে অগণিত কবিতা। কল্পনায় এঁকেছেন মেঘমালার মতো সুপ্ত সুন্দর নিজের কন্যাকে। পঙক্তির চরণে হাতে হাত ধরে হেঁটেছেন মুক্ত ছন্দে, আনন্দে, অবলীলায়। তীব্র আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছেন অনুভূতির পাঠশালা। অতি আবেগে কল্পনাছড়ি দিয়ে কবি লিখেছেন, ‘শ্রবণাকে মনে পড়ে, আমাদের শ্রবণা কি জানে আমার পরাজয়?/ মুখে কিছুই বলতে হয়নি, তবুও বিকেলের ট্রেনে আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে নিতান্ত অন্ধকারে রেখে/ আমাদের গায়ে তপ্ত দীর্ঘ শ্বাস ঢেলে/ ব্যস্ত মানুষেরা যেমন বিচ্ছিরি রকম হোঁচট খেয়ে ও না খেয়েও পথকে গালাগালি করতে করতে হারিয়ে যায় ভীড়ে/ শ্রবণাও কি তেমন হুটোপুটি খেয়ে গল্পে আমাদের বিষাদকে ঢেকে নিস্তব্ধ হয়েছিল?’

ব্যক্তি মামুন প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ না হলেও কবি মামুন রশীদের কবিতাবিলাসী রস ভান্ডারের সেলফে সাজিয়ে রাখা টুপটুপে রসে ভেজানো রসগোল্লার মতোই কল্পনা, ইচ্ছেবিলাসী আবেগের আহ্লাদে টইটম্বুর। ‘তোমার পরে মেঘ জমলে’, ‘কালোপাতা, ওড়ো, সাদাছাই’, ‘এই বইটির কোন নাম দিব না’, ‘কুশল তোমার বাঞ্ছা করি’—গ্রন্থগুলোর প্রতিটি কবিতায় শব্দের প্রয়োগ, কবির কাব্য চেতনার প্রেক্ষিত, চিত্রকল্পের জমকালো গদ্যটান আমাকে মামুন রশীদ থেকে কখনো আবুল হাসান, কখনো সুনীল কখনোবা আল মাহমুদের দরজায় নিয়ে যায় অজান্তেই। সুন্দর নিগূঢ় সংবেদনশীল গঠনশৈলী তার কবিতাকে আলাদা নন্দনে আসন পেতে দিয়েছে। স্বার্থক নিরীক্ষায় দুই পা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তির অবসাদে নুঁয়ে পড়তে দেয় না কবির ‘আমি তোর রাফাখাতা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো। এই কাব্যগ্রন্থে কবিকে মনে হয়েছে আদ্যোপন্ত একজন প্রেমিক পুরুষ। যেভাবে প্রিয়ার গালে প্রথম চুমু আঁকতে সকল নীতিমালা ভাঙতে চেয়েছিলেন; তেমনই বেদনার ভারে নুঁয়ে পড়েননি কবি। প্রতিবাদের নেমপ্লেটে কবিতায় দিয়েছেন দাঁতভাঙা জবাব। তাই তো তিনি লিখেছেন, ‘প্রতিটি ব্যর্থতার পর আমিও পারি/ এই মুষ্ঠিবদ্ধ প্রতিজ্ঞা বেসুরো হয়ে ওঠে/ দৃঢ়তা, সকল ছলাকলা, জমানো আগুন/ তেড়েফুঁড়ে লেলিহান শিখায় ছড়িয়ে পড়ে/ মেহগনির খোলস ফেটে শীতে থরে থরে/ সাজানো বীজগুলো, শুকনো, বিকট শব্দে চিৎকার তোলে। এরাও জল পেলে, রোদ মেখে ফুঁড়ে উঠতে চাইবে আকাশ। এও তো ছলাকলা, জীবনের রঙ্গলীলা, ব্যর্থতাকে উপলক্ষ করে আমন্ত্রণ।’

Advertisement

কবি মামুন রশীদ পৌরাণিকতার জখমে রঙিন করে তুলেছেন কবিতার অঙ্গ, পাশাপাশি মিথের মিথস্ক্রিয়ায় চুবিয়ে পরিশ্রমী মৌমাছির মতো বুনে গেছেন কবিতার পাণ্ডুলিপি। ‘কালোপাতা, ওড়ো, সাদাছাই’ কাব্যগ্রন্থে ঢুকে মনে হয়েছে কবি দর্শনে গ্রাজুয়েট। তবে বাংলায় গ্রাজুয়েশন করা কবির দর্শন উপলব্ধিটা প্রখর হবে—এটাই স্বাভাবিক। অস্তিত্বজ্ঞান, মূল্যবোধ, জগৎ জীবন, মানুষের সমাজ তার চেতনা এবং জ্ঞানের প্রক্রিয়া ইত্যাদির মৌল বিধানের আলোচনাই যদি দর্শন হয় তবে কবি এই কাব্যগ্রন্থের জন্য আমার দৃষ্টিতে একজন নিপুণ দার্শনিকও বটে। মামুন রশীদ লিখেছেন, ‘পৃথিবীও পালায় বিস্মিত বালকের দিগন্ত রেখা ধরে এই শহর ছেড়ে/ ক’জন মানব মানবীকে ফাঁকি দিয়ে/ আরশিতে বদলে দেয় দিগন্ত রেখার সাথে আদল/ গোপন আলাপনে ঢাকে স্বপ্নচারী দৃষ্টি,/ শহর আর আয়নার মাঝামাঝি আমাকে রেখে/ পৃথিবীর এই লুকোচুরি।’ (দর্শক)

‘তোমাদের জনপদে’ কবিতায় দেখি কবির অভিন্ন রূপ। কবিতার কোলে বসে মনে হলো এক ভিন্ন ধারার কবিতা পড়ছি। রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের টানটান উত্তেজনায় কবিতা যখন আমাকে জড়িয়ে ধরলো; বুঝতে পারলাম, কবি রাজনীতিটাও বেশ ভালো বোঝেন। যদিও বাস্তব জীবনে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থাকতেই পছন্দ করেন ব্যক্তি মামুন কিংবা কবি মামুন রশীদ। সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাবলীল উপস্থাপনায় মূলত তিনি প্রেমের কথাই বলেছেন, বর্ণমালা কবিতাটিও তাই। তিনি লিখেছেন, ‘বর্ণমালা, প্রেমে না অপ্রেমে তাকিয়েছিলাম, বুঝিনি।/ প্রথম দেখার মুগ্ধতা তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল/ সেই রেশ, চাইনি হারিয়ে যাক, তোমাকে ছুঁয়ে দেখা যাবে,/ তোমার অফুরন্ত প্রাণশক্তির ভেতর থেকে/ দুঃখ আর আনন্দের ঝর্ণাধারা।’

আরও পড়ুন মামুন মুস্তাফার কবিতা: অন্তরের অনুপ উল্লাস  বাংলা সাহিত্যে সেলিনা হোসেন একটি স্বতন্ত্র নাম

তার কবিতার একজন মুগ্ধ পাঠক হিসেবে বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ পাঠের সুযোগ হয়েছে। যেমন, ‘কালোপাতা, ওড়ো, সাদাছাই’, ‘কুশল তোমার বাঞ্ছা করি’, ‘তোমার পরে মেঘ জমলে’, ‘এই বইটির কোন নাম দিব না’, ‘আমি তোর রাফখাতা’, ‘যা কিছু লিখেছি সব সব প্রেমের কবিতা’। বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে পেয়েছি শিরোনামহীন অনেক কবিতা। শব্দের অভাব নেই যার কাব্যঝুড়িতে; সেই ঝুড়ি থেকে শব্দ তুলে এনে শিরোনাম দিতে পারেননি এ কথা মেনে নেওয়া বোকামি বরং এই কবিতাগুলোকে শিরোনামহীন রেখে একটু চতুরতার প্রমাণ রেখেছেন কবি। পাঠকের ঘাড়ে তুলে দিয়েছেন গ্রহণযোগ্যতার ভার। বেশ, তবে তাই হোক। প্রকৃতি বিলাস, তার চারপাশের জগৎ, শিল্পজগৎ, নিত্যদিনের নাগরিক জীবনের চালচিত্র, ভাঙন, রোদন, সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনপাঠ তুলে এনেছেন বিচিত্র আঙ্গিকে। তাই পাঠকের কাছে কবির প্রত্যাশা প্রকাশ পায় এভাবেই—‘একটু একটু করে মানুষ আমাকে মনে রাখুক/ খোলা মাঠে, আড্ডায়, তৃষ্ণার চেয়ে চায়ের উষ্ণতা বেশি মগ্ন করে/ একটু একটু করে উষ্ণতা শেকড় মেলে/ একটু একটু করে মানুষ/ আমাকে মনে রাখুক/ দু’হাতে চেপে পেয়ালার উষ্ণতায় ভরে তুলুক/ পুরনো স্মৃতিতে কিছু না কিছু ফেলে আসি।/ ভাবি, এইসব স্মৃতিচিহ্ণে/ মানুষ আমাকে জানুক, মনে রাখুক।’ (একটু একট করে: তোমার পরে মেঘ জমলে)।

কিছুটা নিভৃতচারী কবি মামুন রশীদ। এই ডিজিটাল যুগে সামাজিক মাধ্যমে বেশিরভাগ কবি, লেখক যেভাবে আত্মপ্রচার করেন; সেদিক থেকে একটু ভিন্ন ধারার তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি অনেকটাই অনগ্রসর। প্রতি মাসে জাতীয় দৈনিকে চোখে পড়ে তার প্রতিভার স্বাক্ষর। শুধুমাত্র কবিতাই নয়—গদ্য, প্রবন্ধ, উপসম্পাদকীয়, বই আলোচনা, এককথায় সাহিত্যের সব হাঁড়িতেই ভাগ বসিয়ে চলেছেন তিনি। আজকাল পত্রিকায় চোখ পড়ার আগে সাধারণ মানুষের কাছে লেখা চলে আসে মুঠোফোনে অথবা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদিতে। এই বিষয়ে পিছিয়ে থাকা কিংবা অনাগ্রহী কবিকে প্রশ্ন করলে জবাব দেন, ‘লাভ কি? আমার লেখা কি কেউ পড়ে? জীবনে কত লেখাই তো লিখলাম। কার কী লাভ হয়েছে?’ এইসব অভিমানের কথাগুলো আসলে তিনি পাঠকের জন্য ছুঁড়ে দিয়েছেন, সামাজিক অবক্ষয় আর দুর্মূল্যের বাজারে এই অভিমানের গাণিতিক কোনো ক্যালকুলেশন নেই, তবে কোথাও না কোথাও কারো না কারো লাভ তো হচ্ছেই, হয়তো তিনি তার ফিডব্যাক পান না। শুধু পত্রিকার পাতায়, বইয়ে লিখে ফিডব্যাক মেলে না আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে। ফিডব্যাক পাওয়া যায় প্রচারে। কবি যা লিখছেন, পত্রিকায় যা আসছে—তা ফেসবুকেও জানান দিতে হয়, অন্যথায় সাধারণ পাঠক এবং নতুন নতুন পাঠক যারা তৈরি হচ্ছে কিংবা আগামী প্রজন্মও প্রচারবিমুখ মামুন রশীদ থেকে তাদের প্রাপ্তিটা হারাবে। সুতরাং লাভ কি তার জবাব পেতে প্রচারেই প্রসার কথাটি ভেবে দেখতে হবে।

Advertisement

কবি মামুন রশীদ সাহিত্যের সব দিগদিগন্ত চষে বেড়িয়েছেন। সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও লিখেছেন টিটু মিলনায়তন (উপন্যাস), মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস: বগুড়া জেলা; বাংলাদেশের কবিতা, সৃজনে অর্জনে (প্রবন্ধ গ্রন্থ); ষাটের কবি, স্বাতন্ত্র ও বৈভবে (প্রবন্ধগ্রন্থ); জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন—ডিরোজিও, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা, বেগম রোকেয়া, হিটলার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছোটদের জন্য গল্পগ্রন্থ ডাইনি বুড়ি ও অন্যান্য গল্প, সবুজ বাড়ির ভূত, ভূতের সঙ্গে একদিন। মরক্কোর সমকালীন কবিতা (অনুবাদ)। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের ছোট কাগজ দ্বিবাচ্য, ভুতটুস (ছোটদের), নক্ষত্র, সংক্রান্তি।

সাহিত্যের সব শাখায় বহুসত্তার সাফল্যজনক স্বাক্ষর রাখা কবি মামুন রশীদ নিজেই যেন এক ঘোরলাগা কবিতা বলয়। আবেগ মিশ্রিত জীবন ঘনিষ্ঠ তার কবিতাগুলো হৃদয়ে বিভিন্ন ধরনের দ্যোতনা তোলে। কবির ‘যা কিছু লিখেছি সব সব প্রেমের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সত্যিই নিয়ে গেছে এলোমেলো মায়ার ঘরে, এমন মায়ায় তিনি লিখেছেন। এতো প্রেম এক জীবনে জমা রেখে দিন শেষে কবি শূন্য হাতে দাঁড়িয়েছেন ছাতিম ফুলের কাছে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অথবা বকুলের কাছে। শান বাঁধানো পুকুর কিংবা পোষা বাগান কবির ভারাক্রান্ত সময়ের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। মুক্ত বিহঙ্গে চলা কবিকে অনেকটা কর্পোরেট করেছে তার চাকরিজীবন। কখনো কখনো কবি মামুন রশীদ কবিতায় এমন কয়েকটি লাইন একটি জায়গায় এনে ছেড়ে দিয়েছেন, কিছু কিছু কবিতায় হয়তো তা স্বজ্ঞানে বুঝে নেবেন পাঠক, যেমন- অভিশাপ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘নত হতে হতে কেঁচো হয়ে গেছি/ হেরে যেতে যেতে কেঁচো হয়ে গেছি/ ভয় পেতে পেতে কেঁচো হয়ে গেছি/মুখোশ পরতে পরতে কেঁচো হয়ে গেছি।’ কবির এই কেঁচো হয়ে যাওয়ার গল্পে আচ্ছন্ন পাঠককে নিজেকেই খুঁজে নিতে হয় তা বুঝে নেওয়ার পথ। কখনো কখনো এমন অভিমানী কথা আমরা বুঝতে পারি আবার হয়তো কখনো পারি না। তাই বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘কিছু একটা বোঝার জন্য কেউ তো কবিতা লেখে না। এজন্য কবিতা পড়ে কেউ যখন বলে, বুঝলাম না তখন বিষম মুশকিলে পড়তে হয়। কেউ যদি ফুলের গন্ধ শুকে বলে ‘কিছু বুঝলাম না’ তাকে এই কথা বলতে হয়, এটাতে বুঝবার কিছু নেই। এ যে কেবল গন্ধ।’

ভালোবাসার অপূর্ব কবিতা বাগানের মালি কবি মামুন রশীদের এই কবিতাটিও আমাকে ছুঁয়ে যায় আমার কবিসত্তার ডালপালা। তিনি যখন লেখেন, ‘এলোমেলো হতে হতে দিন ফুরানো পাতার মতো/ গলা টিপে ধরা নদীর মতো/ রোদ ঝলসে যাওয়া মুখের মতো/ এত/ বৃষ্টি/ হলো/ ভারী অন্ধকার পেপার ওয়েটের মতো/ আমাকে ভাঙতে ভাঙতে ওর সব ডালপালা/ আনন্দে ঠাসা পাখির বাসার ভেতর পুঞ্জীভূত হলো।/ তুমি দ্যাখো, তোমার জন্যই হাহাকার।’ পরিশেষে পার্সি বিশী শেলীর মতোই বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কবি একটি দোয়েল, যে অন্ধকারে বসে মিষ্টি সুরে আমোদিত করে তোলে নিজেরই একাকিত্ব।’কবিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

লেখক: কবি ও গল্পকার এবং সভাপতি, চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি।

এসইউ/জিকেএস