সাহিত্য

গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০১

ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রয়ী ও কল্পনাশ্রয়ী একটি নাট্যোপন্যাস—গোমতীর উপাখ্যান।

Advertisement

গোমতীর উপাখ্যান-এর কাহিনি গড়ে উঠেছে দুটি শ্রেণিকে কেন্দ্র করে। একদিকে রাজপরিবার, অন্যদিকে প্রজাপরিবার। উভয়ই সমান্তরালভাবে উপস্থাপিত। প্রকাশিত হয়েছে নিকৃষ্ট রাজপ্রাসাদ-ষড়যন্ত্র ও পরিবারকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের বিষাক্ত পরিবেশের পরিণামে যেমন রাজপরিবারের সদস্যরা নিমজ্জিত, তেমনই সাধারণ মানুষের এক রকম অস্তিত্ব-সংকটও প্রকাশিত। অন্ধকার ও ধূসরতা কোনো কোনো চরিত্রের জীবনসমগ্রের প্রতিভাস সৃষ্টি করেছে। এটি যেন ব্যক্তিমানুষের মনোদৈহিক জটিলতার বিন্যাস। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনের বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, আত্মদহন ও ক্রমবর্ধমান ব্যর্থতার সর্বগ্রাসী আকর্ষণে কেউ কেউ হয়ে উঠেছে শূন্য, রিক্ত ও যন্ত্রণাদগ্ধ। গোমতীর উপাখ্যান মনোসংকট ও মনোবিশ্লেষণের নৈপুণ্যে আঙ্গিকগত অভিনবত্ব অর্জন করেছে। ঔপন্যাসিকের আগ্রহ ঘটনা অপেক্ষা মানুষের অস্তিত্বলোকে এবং বহির্জাগতিক ক্রিয়ার পরিবর্তে ব্যক্তিসত্তার বহুমাত্রিক সংকটের ওপর। সৃজনশীল সাহিত্যের শিল্পমাধ্যমে ঔপন্যাসিক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ঘটনাপুঞ্জ ও চরিত্র-অবয়বকে তিনি রূপায়িত করেছেন ক্যামেরার লেন্স দিয়ে। বর্ণনাভঙ্গির অন্তরালে চিত্রনির্মাণ ও নাট্যরীতির অন্তর্বয়ন এক নতুন শিল্পমাত্রা সৃষ্টি করেছে। সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণে সুনিয়ন্ত্রিত শিল্পরীতির সুগঠিত নাটক, স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত।

শূন্যস্রোতযাত্রাদল, দলপ্রধান, গাড়িঅলা, ঠাকুরদা ও নাতনি, অন্যান্য

কতরংপার্থ, অক্ষয় (পার্থের পিতা), লক্ষ্মী (পার্থের মাতা), চন্দ্রা, বিমলা (চন্দ্রার মাতা), রবি (চন্দ্রার ভাই), সুকান্ত (চন্দ্রার প্রেমিক), অমিত (বন্ধু), সুশীলা (পার্থের প্রেমিকা), মিথুন (সুশীলার ভাই), গঙ্গামণি (পণ্ডিত), অন্যান্য

Advertisement

রাজামালামাণিক্য (মহারাজ), কৃষ্ণাভামিনী (প্রথম কন্যা) ও শশিভূষণ (কৃষ্ণাভামিনীর স্বামী), সুহাসিনী (দ্বিতীয় কন্যা) ও উদীয়মান (সুহাসিনীর স্বামী), মনোমোহিনী (তৃতীয় কন্যা) ও নিত্যানন্দ (মনোমোহিনীর স্বামী), রাধারমণ (রাজকবি), অন্যান্য

গোমতীর শূন্যস্রোতবনদে গুরুপদ পদুম পরাগাসুরুচি সুবাস সরস অনুরাগানিস্তব্ধ। গোধূলিলগ্ন শুরু হয়েছে। দূরে—গোমতীতটে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। অস্তসূর্যের বিদায়-আভা কমলা রঙের উত্তরীয়ের মতো গোমতীর বক্ষে এসে পতিত হয়ে আশ্চর্য বর্ণসুষমা সম্পাদন করছে। শঙ্খঘণ্টার মৃদুমন্দ ধ্বনি বাতাসে ভেসে আসছে। শীঘ্রই মন্দিরে মন্দিরে সন্ধ্যা-আরতি শুরু হবে। আকাশ কোথাও বর্ষার সজলকৃষ্ণ মেঘভারে, কোথাওবা আরক্তিম নীরদমালায় সজ্জিত। গোমতী নদী এই মুহূর্তে ধীরগামিনী। তার তরঙ্গ তীরের ওপর মৃদুমন্দ আঘাত করছে। হয়তো তাই একটি সন্ধ্যারাগ ভেসে আসছে দূর থেকে। বিলম্বিত থেকে দ্রুত লয়ে চলে গিয়ে ক্রমশ নিচু হতে হতে হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে রাজপথের কিনারে একটি জনতার জটলা শুরু হয়। তারা গোমতীতটে সূর্য অস্ত যাওয়ার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখছে। সুখস্পর্শ গোমতীর বারিকণা বাতাসের সঙ্গে মিশে তাদের গায়ের ওপর উড়ে এসে পড়ছে, আর আসন্ন সন্ধ্যার মায়াকুহকে ধীরেআস্তে আচ্ছন্ন করছে। এই জটলা থেকেই একজন একটি কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে:আমার এ ঘরে আপনার করেগৃহদীপখানি জ্বালো।সব দুঃখশোক সার্থক হোকলভিয়া তোমারি আলো।কোণে কোণে যত লুকানো আঁধারমরুক ধন্য হয়ে,তোমারি পুণ্য আলোকে বসিয়াপ্রিয়জনে বাসি ভালো।আমার এ ঘরে আপনার করেগৃহদীপখানি জ্বালো।

জনকয়েক কবিতাটির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আবৃত্তি করে। তারাই হাত ওপরে তোলে, হাত ধরাধরি করে দুটি বৃত্ত তৈরি করে। অন্তর্বৃত্তটি ডানদিকে ও অভ্যন্তর্বৃত্তটি বাঁদিকে ঘুরতে থাকে। কবিতা আবৃত্তির এক পর্যায়ে তারা কোমরে হাত রেখে বিপরীত দিকে ঘুরতে থাকে। অভ্যন্তর্বৃত্তের লোকগুলো হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়ে, মুখ নত করে। তারপর অন্তর্বৃত্তের লোকগুলো দৌড়ে এসে শুয়ে-থাকা মানুষগুলোর ওপর ধীরে ধীরে নেমে আসে এবং শুয়ে-থাকা মানুষগুলো মাটিতে এক টানে তুলে হাঁটুর ওপর বসিয়ে দেয়, মুখোমুখি করে। দুটি দেহ এক সত্তা নিয়ে যেন বহমান, তবে স্বতন্ত্র থেকে যায় তাদের হাত-পা। জটলার কেন্দ্রবিন্দুতে একজন নারী কত্থকনৃত্যের মুদ্রায় ও তিনতাল ছন্দে ‘চাল’ ব্যবহার করে নড়তে থাকে। তারাই শুরু করে জারিগান: ও দয়াল প্রভু তুমি বড় দয়াময়মোরা তব অধম সন্তান করি নির্ভয়।প্রথমে বন্দনা করি পুবে ভানুশ্বরপুবেতে উদয় তার, প্রসার চারিধার।পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা পুণ্যস্থানপুণ্য হতে সেথায় যায় মু’মিন-মুসলমান।উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বতযার বুকে জনম ওগো নদী শত শত।দক্ষিণে বন্দনা করি বঙ্গোপসাগরযেথায় ধ্যানে মগ্ন আছেন তারকা ঈশ্বর।মাতা বন্দি পিতা বন্দি, বন্দি গুরুজনআরও বন্দি সকল সুধীজন।ত্রিপুরা অঞ্চল থেকে মোদের আগমনপবিত্র অন্তরে করি সত্য নিবেদন।

পুরো বিষয়টিই অদ্ভুত। জারিগান শেষ করে দলপ্রধানের পাশে এসে দাঁড়াল জটলাটি। দলপ্রধানের ক্লান্তি যেন তার পদতলে। তার দেহ পরিশ্রান্ত। কিন্তু তার চোখে-মুখে তেজস্বিতা। তার ইঙ্গিতে তাকে ঘিরে এগিয়ে চলেছে জটলাটি। সবাই সতর্ক। তারা গরুরগাড়ি আরোহণে এগোচ্ছে। হেঁটে এগোচ্ছে। ইচ্ছে করে হেঁটে যাচ্ছে না বরং বাধ্য হয়েই এগোচ্ছে, কেননা তারা এখন বিধ্বস্ত, ক্লান্ত। এই অবস্থায়ও তারা হেঁটে চলেছে। উন্নত মস্তক তাদের। প্রতিটি পদক্ষেপ বলিষ্ঠ। কে বা কারা দলপ্রধানের সঙ্গে যাচ্ছে, সেদিকে তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। সে জানেই, যাদের সঙ্গে সে এগিয়ে যাচ্ছে, তারাই চারদিক ঘিরে তাকে পদব্রজে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। যেন মাতাল হাতিকে ঘিরে নিয়ে চলেছে অতি সাধারণ মানুষেরা। এই মুহূর্তে এবং আগেও কখনো তার দলের কাউকে সাধারণ মানুষের অধিক কিছু ভাবছে না, ভাবেওনি। তাই তাকে এখন যারা ঘিরে আছে, তাদের দিকে তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজনবোধ করছে না দলপ্রধান। দলপ্রধানের ক্লান্তি যেন তার পদছন্দে। নিরুদ্বেগ তার পদযাত্রা। ক্ষুধাতৃষ্ণা তার চারপাশকে অন্ধকার করে ফেলছে। সে মনে-মনে বলল: এখান থেকে গন্তব্যস্থলে যাব কী করে? সবকিছু মিলেমিশে তার যখন আকাশপাতাল অবস্থা, তখন তার সামনে এসে দাঁড়াল একটি গরুরগাড়ি। এই মুহূর্তে সে বড্ড তৃপ্তিবোধ করছে। উচাটন ভাবকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে সকলকে ভূতগ্রস্তের মতো সেদিকে টেনে নিয়ে চলে দলপ্রধান উচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করে: এই যে গাড়িঅলা ভাই, যাবে?গাড়িঅলা নিরুত্তাপ কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো, যাব। কোথায় যাবেন?টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে দলপ্রধান বলল, রাজবাড়ি?ময়নামতী?আজ্ঞে। তবে মাঝখানে একটি নদী আছে।মিশ্র প্রতিক্রিয়া চোখে-মুখে ধারণ করে গাড়িঅলা বলল, গোমতী। আমি খেয়াঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি। তারপর নৌকাযোগে ওপারে গিয়ে আবার গরুরগাড়ি নিতে হবে।দলপ্রধান ভাবল, এই-যে হুট করে এখানে দলবল নিয়ে চলে আসা, পুরো ব্যাপারটাই ঝোঁকের মাথায় ঘটেছে। হয়তো তাই অস্বস্তি নিয়ে, করুণ চোখে গাড়িঅলার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, কত ভাড়া দিতে হবে?শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে গাড়িঅলা বলল, অনেক।আকাশ থেকে পড়া কণ্ঠে দলপ্রধান বলল, কতটা পথ?পাঁচ ক্রোশ। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। গাড়িঅলা গভীর চোখে তার সামনে দণ্ডায়মান দলপ্রধানের দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর বলল, আপনারা কি যাত্রদলের মানুষ?ম্লান চোখ দুটি গাড়িঅলার মুখের ওপর রেখে দলপ্রধান বলল, আজ্ঞে।তাহলে উঠুন। কম রাখব।এই কথার কোনও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে, হঠাৎ দলপ্রধান বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি যাত্রাপালা পছন্দ করো?করি।এখানে ঝোঁকের মাথায় এসে দলপ্রধানকে বেশ অসহায় মনে হচ্ছে। ঝোঁকের মাথায় এভাবে আসা উচিত হয়নি। এই রকম ভেবে নিজেকে শাসিয়ে গাড়িঅলার উদ্দেশ্যে বলল, নদীতট থেকে রাজবাড়ির পথটি কেমন? কাঁচা পথ। মাঝেমধ্যে কাদামাটি। তার ওপর দিয়ে যেতে হবে।বুক চিরে গভীর নিবিড় একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো দলপ্রধানের। ম্লান চোখে বলল, ঠিক আছে। আমরা যাবো। তার কণ্ঠ দৃঢ় এবং কিছুটা রুক্ষও।

Advertisement

ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত নিঃশেষিত শক্তির দলপ্রধানের নির্দেশে সকলে গরুরগাড়িতে উঠতে থাকে। সবুজ ঘাসের খাঁজে খাঁজে অন্ধকার জমে আরও গাঢ় করে তুলেছে। ঠিক তখনই ঠাকুরদা তার নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে রাস্তায় এসে উপস্থিত হন।

নাতনিটির মায়ের যখন মৃত্যু হয় কতই-বা তার বয়স তখন! ঠাকুরদার এখনো মনে পড়ে সেই বিশেষ দিনটির কথা। তার একমাত্র বউমার ছায়া পড়েছিল ঘরের মেঝেয়। দরজার মাথা সূর্যের শেষ আলোয় রাঙা হয়ে উঠেছিল। উঠোনে তখন খেলা করছিল তার নাতনিটি। ঠিক এক কদম দূরে দাঁড়িয়ে ঠাকুরদা রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করছিলেন। বসন্তের হাওয়া, ফুলের গন্ধ আর আলয়ে ফেরা পাখির গান অজানা এক স্বপ্নপুরীর ইঙ্গিত শুরু করেছিল মাত্র। স্পষ্ট ধারণা করতে পারেনি নাতনিটি তখন কিছুই। কিন্তু তার মন ছিল চঞ্চল। ঠাকুরদা পদভাঙার চেয়েও চঞ্চল। তার মুখের ত্বকের নিচে সারা শরীরের রক্ত যেন এসে জমাট বাঁধে। সে এক ব্যথাভরা পুলকে শরীরে কেমন যেন এক অজানা শিহরণ জাগে। খেলতে খেলতে এক সময় নাতনিটি ছুটে আসে ঠাকুরদার পাশে। উঠোনের অপরদিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখায়। ঠাকুরদা দেখেন ডাক্তার ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলেছেন অনির্দিষ্টভাবে। বোধহয় বায়ুসেবন করছেন। নাতনির চোখের তারা দুটি উজ্জ্বল। ঠাকুরদার কানের কাছে মুখ এনে উত্তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল, কী হচ্ছে? কেন যেন ঠাকুরদার দম বন্ধ হয়ে আসে। তিনি তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, জানি না। তারপর নাতনিটির চিবুক ধরে নাড়া দিয়ে এবং তাকে কোলে তুলে নিয়ে হরিণের মতো লাফাতে লাফাতে ডালিম গাছের পাশে এসে বসে পড়েন, নাতনির গায়ে গাল ঠেকিয়ে। মনে যখন সন্দেহ জাগে, সংশয়ের দোলায় যখন মন দুলতে থাকে, তখনই ঠাকুরদার বউমা যেন তার সমস্ত সত্তা দিয়ে তার স্বামীকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। স্ত্রীর কাছে একবার গিয়ে দাঁড়াতে পারলে যেন স্বামীর সমস্ত সংশয়, সকল দুশ্চিন্তা তামাকের সাদা ধোঁয়ার মতো মুহূর্তে অনন্ত আকাশে মিলিয়ে যায়। স্ত্রী যেন স্বামীর শান্তি ও ধৈর্যের প্রতিমূর্তি; তিনি যেমন তার সন্তানের জননী, তেমনই যেন স্বামীর আশ্রয়স্থল। তার রূপ, শয্যাশায়ী হয়েও যেন কিছুমাত্র ভাটা পড়েনি, শুধু গালের রক্তিমাভা এখন আর দেখা যায় না। মুখখানি যেন সাদা মোম। তার অপূর্ব ছন্দের দেহটিও মোমের মতো শুভ্র হয়ে চলেছে। ডাক্তার বলেছেন রক্তাল্পতা দেখা দিয়েছে রোগীর শরীরে। স্বামীর সেজন্যে দুশ্চিন্তার অবধি নেই। তার হাসিমাখা মুখের ওপরে কীসের যেন ছায়া উদ্ভাসিত। তার আদেশে গৃহকর্মীরা আঙুরের নির্যাস নিয়ে ছোটাছুটি করে। খাওয়ার জন্য সাধে। স্ত্রী শুধু হাসেন। স্বামীর ব্যস্ততা বসে বসে উপভোগ করেন। শয্যাশায়ী স্ত্রীর স্ফীত উদরের দিকে তাকিয়ে স্বামীর বড্ড কষ্ট হয়। এখন যেন স্ত্রীর অন্তিম ক্লান্তিটাই বিশাল হয়ে ধরা পড়ে স্বামীর চোখে। মুহূর্তে স্বামীর চোখের ভাষা পালটে যায়। অগাধ স্নেহধারা বেয়ে পড়ে তার চোখের দৃষ্টিতে। কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে যান স্বামী। ধীরে ধীরে স্ত্রীর শিয়রে এসে তার কপালের উত্তাপ দেখেন। তারপর নিষ্পলক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ক্লান্ত স্ত্রীর চোখ দুটি তখন বন্ধ। খুব ধীরে তার শ্বাস পড়ে। হঠাৎ তিনি ছটফট করতে থাকেন। তার চোখ দুটি বিশাল আকার ধারণ করে। নাতনিকে গৃহকর্মীর কাছে রেখে ঠাকুরদা ছুটে তার বউমার পাশে এসে বলেন: বউমা এমন করছো কেন? কোনো উত্তর আসে না। ডাক্তারও পাগলের মতো ছুটে আসেন। নিজেকে বড্ড অসহায় বলে বোধ করেন। তিনি দেখেন তার রোগীর চোখ নিমীলিত—মুখ শান্ত। তিনি রোগীর ডান হাত সযত্নে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করতে থাকেন। অনেকক্ষণব্যাপী পরীক্ষা করতে থাকেন। শেষে ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে নিজের মুখ ঢাকেন। ঠাকুরদার পদতলের মেঝে যেন সরে যায়। তিনি টলতে থাকেন। ঠিক সেই সময়ে তার পুত্র অবোধ শিশুর মতো কঠিন মেঝের ওপর বসে কেঁদে ওঠেন। স্বামীর এই ক্রন্দন শুনলেন ডাক্তার, শুনলেন ঠাকুরদাও, আর অতি সামান্য নাতনিটি। সে এই মুহূর্তে তার পিতাকে চিনে নিলো। তার হৃদয়কে চিনলো। সামনে শয্যার ওপর তার বউমার মৃতদেহ। ভূতলে তার পুত্র কেঁদে ভাসাচ্ছেন। তার হাতে ধরা তার একমাত্র নাতনিটি, তিনি তাকে শক্তমুষ্টিতে ধরে রাখেন। একটি চাদরে দেহ-মাথা-মুখ ঢাকা মায়ের কথা এখনো নাতনিটির মনে আছে। চতুর্দিকে তার যেন সব শূন্য হয়ে যায়। তার পাশে কিছু নেই! তার পায়ের নিচে কিছুই নেই, কোনো দিকে কিছুই নেই। আশ্রয়ের জন্য আকুল হয়ে সে হাত বাড়ায়। আশ্রয় মেলে। ঠাকুরদার বক্ষের নিবিড়তা। সেই থেকে ঠাকুরদার সঙ্গী তার নাতনি। তিনি যেখানেই যান—নাতনি তার সঙ্গী।

বাড়ির সামনের ডালিম গাছটি ডিঙিয়ে যখন ঠাকুরদা-নাতনি গরুরগাড়িটির সামনে এসে উপস্থিত তখন হঠাৎ ঠাকুরদা রাশভারী ও ভীষণ-গম্ভীর কণ্ঠে তার নাতনিকে বললেন, তাড়াতাড়ি হাঁটেন দিদিমণি। আপনার পায়ে কি ব্যথা ধরেছে? এই তো আরেকটুকু পথ। চলুন দিদিমণি, চলুন।নাতনির পাল্টা প্রশ্ন, তালপাতার বাঁশির জন্য কি এতটা পথ হাঁটতে হয়? আজ্ঞে দিদিমণি, হাঁটতে তো হয়ই বটে।আমাকে কিন্তু একটা মুখোশ কিনে দিতে হবে। তাহলে তো আপনাকে আর-একটু হাঁটতে হবে।হঠাৎ গরুরগাড়িতে বসা দলপ্রধানের দৃষ্টি গিয়ে বেঁধে ঠাকুরদার ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই সে বলে উঠল, ঠাকুরদা না! ঠাকুরদা, ওগো ঠাকুরদা। কোথায় যাচ্ছ?গরুরগাড়ির ভেতরে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে ঠাকুরদা বললেন, তুই অমন করে ডাকছিস কেন? এই বেলায় আবার কোথায় ছুটলি?রাজবাড়িতে।কেন?সেখানে আমাদের একটা যাত্রাপালা আছে। তাই দলবল নিয়ে ছুটছি।সাবধানে যাস ভাই। দুর্গা, দুর্গা।ইত্যাকল্পবিকল্পতল্পরচনাসঙ্কল্পলীলাশত—ব্যাসক্তাপি বিনা ত্বয়া বরতনুনৈষা নিশাং নেষ্যতি \

সূর্য অস্ত গেছে।আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে ত্রিপুরায়। গরুরগাড়িটি এগিয়ে চলে। দূরে গ্রামগুলোয় অন্ধকার ক্রমশ জমতে থাকে। গরুরগাড়ি আস্তে আস্তে লাল মাটির পথ ধরে। পাল্টে যাচ্ছে আশেপাশের বৃক্ষরাজির ধরন। জঙ্গল দূর থেকে এগিয়ে আসছে গরুরগাড়িকে লক্ষ্য করে।

অন্যদিকে, গ্রামের হাটে হাট জমে উঠেছে পুরোদমে। দুই সারিতে দোকান বসেছে। তার মধ্যে কয়েকটি দোকানে খেলনা, মুখোশ ইত্যাদি রয়েছে। ঠাকুরদা তার নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে মুখোশের দোকানের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। মুখোশগুলো সুতো দিয়ে ঝোলানো। কৃষক ও কৃষাণির মুখোশগুলো রঙিন: কালো, হলুদ, লাল এবং পরিপাটি; শুধু ভেতর থেকে আঠা শুকিয়ে টানটান হয়ে আছে। কৃষক ও কৃষাণির মুখোশগুলো দেখে নাতনির চোখে আগ্রহ দেখা দেয়। এগুলো তার কাছে বাস্তব বলে মনে হয়। জল্লাদের মুখোশের মোচ বাঁকা; কিন্তু পরিপূর্ণ; রং ও প্রকৃতি রহস্যময়। কত স্বাভাবিক, অথচ কত অস্বাভাবিক। অস্বাভাবিকের অন্তরালে ভয়ংকর কিছু লুকিয়ে আছে। এক সময় এসব জল্লাদের মুখোশ তাকে আকুল করে তুলল, নিজেকে আর সামলাতে পারল না। এক অজানা আশঙ্কায় তার বুক কেঁপে ওঠে। চোখ বেয়ে অবিরল ধারে ভয় ঝরে পড়ছে। তার অতিসুন্দর মুখখানা ভয়ে থমথমে। ধীরে ধীরে ঠাকুরদার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ঠাকুরদার গায়ের সুগন্ধ পেয়ে সে যেন সম্বিৎ ফিরে পায়, যদিও সে বিহ্বল। তারপর বলল: ঠাকুরদা, আমার কোনো মুখোশের প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে বরং তুমি আমাকে একটা গল্প শোনাও। এমন গল্প শোনাবে যেন বাড়ি না-পৌঁছানো পর্যন্ত শেষ না হয়।

ঠাকুরদার মুখ নিচু হয়। এক পলক নাতনিকে দেখে নিলেন। ঝাপসা আঁধারে নাতনির মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু তার ভয়পূর্ণ চোখ দুটি স্থির সরোবরের মতো টলটল করছে। এই চোখের দৃষ্টি কয়েক দণ্ড ঠাকুরদার চোখের সঙ্গে জট পাকিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তিনি মুখ তোলেন। তারপর ধীরগম্ভীর স্বরে বললেন, ঠিক আছে।

পুলক-শিহরণ প্রবাহিত হয় নাতনির শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরায়। ঠাকুরদার বলিষ্ঠ মুষ্টির মধ্যে হাত রেখে বলল, সত্যি বলবে তুমি?

হ্যাঁ। আপনি এসে দাঁড়িয়েছেন আমার পাশে—এ যেমন সত্য, তেমনই সত্য ত্রিপুরার একটি গল্প: রাজমালা, যা আপনাকে বাড়ি যেতে যেতে শোনাবো।

নাতনি নিশ্চুপে থাকে। পাথরের মতো যেন স্থির তার মুখমণ্ডল। ঠাকুরদা কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। দেখতে পেলেন যেন তার নাতনির অন্তরে অদমনীয় কৌতূহল বিরাজ করছে। তার স্তব্ধতার দিকে তাকিয়ে ঠাকুরদা আর কোনো প্রশ্ন করতে তার মন সায় দিলো না। ধীরে ধীরে নাতনি হাঁটতে শুরু করে ঠাকুরদার পানে তাকিয়ে। এই দৃষ্টিতে কীসের যেন ব্যাকুলতা। এই ব্যাকুলতা-ভরা চাহনি দিয়ে ঠাকুরদার দৃষ্টিকে বন্দি করে রেখে সে বলল, তাহলে শুরু করো।ঠাকুরদা বললেন, অনেক দিন আগে, আমাদের ত্রিপুরা রাজ্যে একজন মহারাজা ছিলেন। তার ছিল ত্রয়ী কন্যা...নাতনির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

চলবে...

এসইউ/জিকেএস