‘বুলেট বুকের ভেতরে ঢুকে পিঠ ছিদ্র করে বের হয়ে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। ভাইকে মিরপুর-১০ নম্বরের আল হেলাল হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু কোথাও ভর্তি করতে পারিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয়। রক্তক্ষরণ কোনোভাবে কমানো গেলে হয়তো বাঁচানো যেত।’
Advertisement
সোমবার (২৯ জুলাই) কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাগো নিউজকে কথাগুলো বলছিলেন মুরাদ হোসেন। তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষ চলাকালে নিহত মামুন সর্দারের ছোট ভাই।
নিহত মামুনের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের ঘাটমাঝি ইউনিয়নে। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে মামুন চতুর্থ। ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা আসেন তিনি। প্রথমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ছোটখাটো চাকরি করেন মামুন। বছরখানেক আগে এইড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান।
স্ত্রী, ১৪ মাস বয়সী মেয়ে ও ভাই মুরাদকে নিয়ে মিরপুর-১৪ নম্বর সংলগ্ন ইব্রাহিমপুরে ভাড়া থাকতেন মামুন। অফিসও বাসার কাছাকাছি। ভাই মুরাদও চাকরি করেন ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডে।
Advertisement
গত ১৯ জুলাই বিকেল ৫টার পরে অফিসের কাজ শেষে কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মামুন। মিরপুর-১৩ নম্বর বিআরটিএর বায়তুল জান্নাত মসজিদ সংলগ্ন গলিতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে ঢামেকে নেওয়ার পথে মারা যান বলে জানান তার ছোট ভাই।
ছাত্র আন্দোলনের কারণে তাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে পারিনি। গাড়ি ঘুরিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করি। তখন পর্যন্ত ভাইয়া জীবিত ছিল। আনুমানিক ৭টার দিকে তিনি মারা যান।– নিহত মামুনের ভাই মুরাদ
সোমবার (২৯ জুলাই) কথা হয় মামুনের ভাই মুরাদ ও ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বেলালের সঙ্গে।
মুরাদের দাবি, নিহত মামুন কোনো ধরনের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। গত ১৭ জুলাই তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের ছবি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল ছবি হিসেবে দেন।
Advertisement
১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ছয়জন নিহত হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন আবু সাঈদ। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র সাঈদ কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। যার ছবি মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
আরও পড়ুনরাস্তায় বেরোতেই হঠাৎ কী যেন এসে পেটে লাগে, হাত দিয়ে দেখি রক্তদুই ঈদে বাড়ি আসেনি, লাশ হয়ে ফিরলো মায়ের কাছেশরীরে গুলির ক্ষত, জীবনে অনিশ্চয়তাএর দুদিন পর ১৮ জুলাই মামুন গুলিবিদ্ধ হন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিষয়টি জানতে পারেন মুরাদ। একই সময়ই জানতে পারেন প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর বেলাল। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘ওইদিন বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটে। অফিস শেষ করে মামুন কোনো কারণে বিআরটিএর ওইদিকে যান। মামুন আমার প্রতিষ্ঠানে ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার ছিলেন।’
ভাই যখন বাসায় আসতেন মেয়ে বাবার সঙ্গে থাকতো। সব সময় তার বাবা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। ছোট বলে সে কিছু বলতে পারে না। তবে সারাদিনই বাবাকে খুঁজে বেড়ায়
‘তিনি আন্দোলনে জড়িত ছিলেন না। বিআরটিএর সামনের হুড়োহুড়িতে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তখন তার সঙ্গে আরও দুজন সহকর্মী ছিলেন। তারা তাকে (মামুন) নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।’ যোগ করেন বেলাল।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভাই মুরাদ বলেন, ‘আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আমার কাছে ফোন আসে। আমি দ্রুত ঘটনাস্থলে যাই। প্রথমে তাকে ১০ নম্বর আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওনারা অন্য কোথাও নিয়ে যেতে বলে। পরে পঙ্গুতে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়, ব্যান্ডেজ করা হয় বুকে। তবে তাতেও রক্তক্ষরণ কমেনি। পঙ্গু থেকে রোগীকে মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।’
‘পরে একটা অ্যাম্বুলেন্সে তাকে মহাখালী পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারি। তবে ছাত্র আন্দোলনের কারণে তাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে পারিনি। গাড়ি ঘুরিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করি। তখন পর্যন্ত ভাইয়া জীবিত ছিলেন। আনুমানিক ৭টার দিকে তিনি মারা যান।’ যোগ করেন মুরাদ।
মুরাদ বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে ভাইয়াকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। দায়িত্বরত চিকিৎসক দেখেই ডেড ঘোষণা (পালস চেক করে) করেন। বোধহয় পথেই মারা তিনি যান।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুরাদ বলেন, ‘আমার ভাই কোনো রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। স্বাধীন দেশে বিনা অপরাধে গুলিবিদ্ধ হলেন। এখন আমরা সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চাই।’
মামুনের অবুঝ শিশু মানহা তার বাবাকে খুঁজে বেড়ায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাচ্চা অবুঝ হলেও মাঝে মধ্যে কান্না করে। ভাই যখন বাসায় আসতেন মেয়ে বাবার সঙ্গে থাকতো। সব সময় তার বাবা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। ছোট বলে সে কিছু বলতে পারে না। তবে সারাদিনই বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। কান্না করে।’
এসএম/এএসএ/জেআইএম