দেশজুড়ে

শান্ত আবিরের শোকে মা পারভীন সুলতানা পাগলপ্রায়

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই বিকেলে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে ঢাকার বারিধারা এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আবদুল্লাহ আল আবির (২৪)। তিনি বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসএস পদে চাকরি করতেন। ২০ জুলাই সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

Advertisement

আবিরের স্মৃতিবিজড়িত বরিশাল নগরীর গোরাচাঁদ দাশ রোডের শত বছরের পুরোনো ‘মাহমুদালয়ে’ গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ পুরো বাড়ির লোকজন। কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সবাই। ঘরের মধ্যে শুধু এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিল আবিরের একমাত্র ভাগনে (২)। সবার মুখে শুধু একই কথা—‘এখন আপনারা আর কী লিখবেন? লিখলে কী আর আবিরেকে ফেরত পাবো?’

প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরীর গোরাচাঁদ দাশ রোডের ‘মাহমুদালয়’ নামের পুরোনো বাড়িটি আবিরের বাবার মামার বাড়ি। এখানেই ছোট বড় হয়েছেন আবির। তাদের গ্রামের বাড়ি বাবুগঞ্জ উপজেলার ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে। এলাকায় বেশ শান্ত ও চঞ্চল স্বভাবের তরুণ হিসেবে পরিচিত ছিলেন আবির। এলাকার সবার সঙ্গেই ছিল তার সখ্য।

আবির ২০১৭ সালে বরিশাল উদয়ন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর বছর দুয়েক গ্যাপ দিয়ে ভর্তি হন রাজধানীর মিরপুর বাঙলা কলেজে। সেখান থেকে পাস করেন এইচএসসি।

Advertisement

আরও পড়ুন:

‘এখন কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না’

আবিরের মা পারভীন সুলতানা ঘরের বিভিন্ন স্থানে ছেলের ছবি, খেলাধুলায় পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার ও স্কাউটে পাওয়া সম্মাননা পুরস্কার দেখাতে দেখাতে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। পাশে বসে আবিরের বড় বোন মারিয়া ইসলাম অশ্রুভেজা চোখে মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। এসময় মারিয়ার দুই বছরের শিশু বারবার বলছিল, ‘মামার গুলি লাগছে, মামা মাটির নিচে ঘুমায়’।

পারভীন সুলতানা কান্না করতে করতে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার নাড়িছেঁড়া ধন আবির কখনোই গ্রামের বাড়ি যাইতে চাইতো না। তারপরও ওদের থাকার জন্য গ্রামে একটা বাড়ি করেছি। কিন্তু সেখানে কখনোই ও যেতে চায়নি। আর এখন সেই গ্রামের মাটিতেই ওর ঠাঁই হয়েছে।’ এ কথা বলতে বলতে মূর্ছা যান তিনি।

বড় বোন মারিয়া ইসলাম বলেন, ভাই আবির পড়াশোনার চেয়ে খেলায় খুব মনোযোগী ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি খেলেছে। সব খেলায় তার অংশগ্রহণ ছিল সবার আগে। বিভিন্ন খেলায় পেয়েছে একাধিক পুরস্কার। পাশাপাশি শিক্ষাজীবনে করেছে রোভার স্কাউট। পেয়েছে একাধিক সন্মাননা। সবশেষ গত বছরের ১৩ আগস্ট চাকরির জন্য ঢাকায় যায়। পরদিন (১৪ আগস্ট) নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসএস পদে চাকরিতে যোগদান করে। কিন্তু এসব এখন কেবলই স্মৃতি।

Advertisement

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মারিয়া ইসলাম বলেন, ‘১৯ জুলাই দুপুরের খাবার খেতে আবির বারিধারার বাসায় যায়। খাবার খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার কর্মস্থলে যায়। পরে সন্ধ্যায় ওর এক বন্ধু ফোন করে জানায়, আবির অসুস্থ, গুলশান মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে। দৌড়ে সেখানে গেলে জানতে পারি, ওকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে ভাইকে বাঁচানোর জন্য ১৪ ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই করি। বিভিন্ন স্থান থেকে ১২ ব্যাগ রক্ত দিয়েছি। তবুও ভাইকে বাঁচাতে পারলাম না।’

আরও পড়ুন:

বাবা-মায়ের সুখের সঙ্গে আপসহীন ছিলেন সাংবাদিক মেহেদী

চিকিৎসকরা জানান, আবিরের পেটে গুলি লেগেছে। যে কারণে প্রচুর রক্ত ঝরেছে। কোনো কিছুতেই যেন রক্ত থামছিল না। পরে রাত ১২টায় অস্ত্রোপচার শুরু হয়ে চলে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। অস্ত্রোপচার শেষে আবিরকে রাখা হয় আইসিইউতে। পরদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মারা যায়। তারপর তার মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি দাফন করা হয়।

এদিকে আবিরের মৃত্যুর এতদিন পার হলেও এখন পর্যন্ত কেউ কোনো খোঁজখবর নেয়নি বলে আক্ষেপ তার পরিবারের সদস্যদের।

এ বিষয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নিহতদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় সারাদেশে ১৪৭ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৪ জনকে দাফন করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এই ১৪ জনের মধ্যে আবদুল্লাহ আল আবির একজন।

শাওন খান/এসআর/এমএস