পুরো বাড়িতে সুনসান নীরবতা। নির্বাক পরিবারের সদস্যরা। শতবর্ষী মা গুলজান বেগম খাটে শুয়ে ছেলের ফ্রেমবাঁধানো একটি ছবি নিয়ে বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন। কিডনি, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ সমস্যায় আক্রান্ত মায়ের আহাজারি কোনোভাবেই থামছে না। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও নেই কারো। বার বার তিনি আহাজারি করে বলছেন, তোমরা আমার কলিজার টুকরো ছেলেকে এনে দাও। আমার ছেলে নেই, এখন কে আমাকে ওষুধ কিনে দেবে? আমার ছেলেকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই।
Advertisement
কোটা সংস্কার আন্দোলনে দুর্বৃত্তের হামলায় গত ২১ জুলাই নিহত হন নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক (ওসি) মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া। এ ঘটনায় তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের কালান্দরে চলছে শোকের মাতম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ি ইউনিয়নের কালান্দর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া ও গুলজান বেগমের আট ছেলে-মেয়ের মধ্যে মাসুদ ষষ্ঠ। ১৯৯৬ সালে তিনি উপ-পরিদর্শক হিসেবে পুলিশে যোগদান করেন। অনেকদিন ধরে তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ঢাকার বনশ্রী এলাকায় বসবাস করতেন। তার বড় মেয়ে উম্মে মাইশা স্নেহা ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। মেজো মেয়ে উম্মে মাহিরা নেহা এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। সবার ছোট আহনাফ মাহিন ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।
নিহত মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়ার ছোট ভাই সোহেল ভূঁইয়া বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়দায়িত্ব ছিল ভাইয়ের হাতে। আমাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন তিনবেলা খাবারের আগে মায়ের খবর নিতেন। মাস শেষ হওয়ার আগেই মায়ের ওষুধ কিনে পাঠিয়ে দিতেন। প্রতিমাসে মাকে একবার ডাক্তার দেখাতেন।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে কর্মরত থাকলেও ঢাকার বাসা থেকে গিয়ে অফিস করতেন। ঘটনার দিন বাসা থেকে চা খেতে সন্ধ্যার পর বের হন তিনি। পরে অপরিচিত নম্বর থেকে বাসায় কল দিয়ে জানানো হয় ভাইকে কুপিয়ে রাস্তার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। তাকে এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে যে মানুষ মানুষকে এভাবে কখনো মারতে পারে না। আমি আমার ভাই হত্যার সঠিক বিচার চাই।
নিহতের স্ত্রী মেরিনা আক্তার বীনা বলেন, গত রোববার দুপুরে তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। প্রধানমন্ত্রী হত্যার বিচারের পাশাপাশি সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন। কোনো সহযোগিতা না পেলে তিন সন্তানকে নিয়ে চলা খুব কষ্ট হয়ে যাবে।
তিনি আরও জানান, সেদিন মাসুদকে বাসা থেকে বের হতে না করেছিলাম। কিন্তু সে সবাইকে সতর্ক করে নিজেই বের হয়ে মৃত্যু ডেকে আনলো। তার সমস্ত শরীরে শুধু আঘাতের চিহ্ন। ধারালো অস্ত্র ও রড দিয়ে মাথায় শরীরে আঘাত করা হয়। পরে স্থানীয় এক নারী রাস্তা থেকে মাসুদকে তুলে নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার (২১ জুলাই) সকালে মারা যায়। পরে ওইদিন রাতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এলাকাবাসী জানান, পুলিশ পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া ছিলেন পরোপকারী মানুষ। কেউ সমস্যায় পড়ে এলাকার নাম বলে কল দিলেই তিনি সমাধান করে দিতেন। তার মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না এলাকাবাসী।
Advertisement
আঠারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুবের আলম কবির রূপক বলেন, নিহত মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া আমাদের এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। ব্যক্তি হিসেবে তিনি পরোপকারী ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমরা একজন ভালো মানুষকে হারিয়েছি।
মঞ্জুরুল ইসলাম/এফএ/জেআইএম