কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গত ২৫ জুলাই চাকরি থেকে ‘স্বেচ্ছায় অবসরের’ আবেদন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জাহিদুল করিম। তার চাকরি ছাড়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকে ওই শিক্ষকের প্রশংসা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও দেন। দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে।
Advertisement
ঘটনার একদিন পরই বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেখানে শিক্ষক জাহিদুল করিমের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানানো হয়। জাবি প্রশাসনের বিবৃতিতে বলা হয়, পরীক্ষা কমিটি পুনর্গঠন ও পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সহযোগিতার অভিযোগে জাহিদুল করিমের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। তিনি প্রশাসনের শাস্তি এড়াতে চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন।
জাহিদুল করিমের চাকরি থেকে অব্যাহতি এবং তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিবৃতিতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়। যারা প্রথমে ওই শিক্ষকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তারাও বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে যান। তবে জাহিদুল বর্তমানে শিক্ষাছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় এ নিয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছিল না।
প্রশাসনের বিবৃতিতে জাহিদুলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়, তা নিয়ে জানতে ওই শিক্ষকের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করেন জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক। রোববার (২৮ জুলাই) দুপুরে বিষয়টি নিয়ে ই-মেইলে নিজের বক্তব্য জানিয়েছেন জাহিদুল করিম।আরও পড়ুন
Advertisement
তাতে শিক্ষক জাহিদুল দাবি করেছেন, তিনিই ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের এমবিএ চতুর্থ ব্যাচের পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে তৎকালীন উপাচার্যকে অনুরোধ করেছিলেন। তার প্রেক্ষিতেই ওই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এটা তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি নয়। এখন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোয় জাহিদুল করিমের করা অভিযোগ তদন্তে করা কমিটিকে তার বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রশাসনের বিবৃতির জবাবে জাহিদুলের বক্তব্যজাহিদুল করিম ই-মেইলে পাঠানো নিজের বক্তব্যে লিখেছেন, ‘মে ৪, ২০২০ তারিখে আমি বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব থাকাকালীন এমবিএ চতুর্থ ব্যাচের (শিক্ষাবর্ষ: ২০১৭-১৮) পরীক্ষা কমিটির সভাপতি এবং সদস্য হিসেবে যারা ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলা এবং অনিয়ম তদন্তের উদ্দেশ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য আমি তৎকালীন উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামকে একাধিকবার অনুরোধ করার পরে তিনি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।’
‘আমি আবেদনের সাথে পরীক্ষা কমিটির অনিয়মের প্রমাণ এবং তথ্যসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেও অনুলিপি প্রেরণ করি। বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর (উপাচার্য) ড. নুরুল আলম এ তদন্ত কমিটির প্রধান, যার বিরুদ্ধে কি না পুরো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। আমার মতো শিক্ষক যারা প্রতিবাদী হয়, তারা সব জায়গায় প্রতিবাদ করতে পারে।’
জাহিদুল করিম দাবি করেছেন, ‘তৎকালীন পরীক্ষা কমিটি দোষী প্রমাণিত হতে পারে— এমন ভয়ে এতদিন ভাইস চ্যান্সেলর ড. নূরুল আলম তদন্ত প্রতিবেদন গোপন করে রেখেছিলেন। উনি (নূরুল আলম) জানেন এটা সামনে চলে আসলে আমি মিডিয়াকে সব প্রমাণ দিয়ে দেবো। আমি যখন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি, তিনি এখন সেটাকে আমার বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন।’
Advertisement
‘আশা করি মিডিয়া সব সত্য উদ্ঘাটন করতে পারবে। চার বছর আগে আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে করা তদন্ত কমিটি ওই ব্যাচের পরীক্ষা কমিটির দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অনিয়মের আসল সত্য প্রকাশ না করে, তাদের বাঁচাতে এ প্রতিবেদন আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে প্রেস রিলিজও দিয়েছে প্রশাসন। প্রশাসন আরও বেশি সময় নিচ্ছে কীভাবে অভিযোগপত্রটি নিজেদের মতো করে লিখে আসল সত্য আড়াল করা যায় এবং অভিযুক্ত পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের রক্ষা করা যায়। ড. নূরুল আলমের জন্য শুভকামনা থাকলো’ বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষক জাহিদুল।
বিষয়টি নিয়ে জাবির বর্তমান উপাচার্য ও তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ‘পরিচয়’ ও ‘কথা বলার বিষয়’ লিখে রোববার বিকেল ৪টার দিকে এসএমএস করা হলেও রাত ১১টা পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি।
জাহিদুল করিমের একজন সহকর্মী নাম-পরিচয় প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে, তখন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ হয়েছিল। জাহিদুল করিম যখন বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন তিনি পরীক্ষা কমিটির বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে প্রশাসনে অভিযোগ দিয়েছিলেন। আবার পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা তার বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়াই পরীক্ষা কমিটি পুনর্গঠনের অভিযোগ করেছিলেন।’
তার ভাষ্যমতে, ‘এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। এটা কারও বিরুদ্ধে প্রমাণ হলেও তার চাকরি যাবে না। ছয়মাস বা এক বছর পদোন্নতি আটকে যেতে পারে। সর্বোচ্চ শাস্তি হলে হয়তো পদাবনমন (অর্থাৎ, কেউ সহযোগী অধ্যাপক থাকলে তাকে সহকারী অধ্যাপক করা) করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রশাসন যে বিবৃতিতে দিয়েছে, তা সঠিক নয়।’
এএএইচ/এমএএইচ/