দেশজুড়ে

‘ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে জেনেও পাশে থাকতে পারিনি’

‘ছেলের বুকে গুলি লাগছে শুক্রবার। চার দিন ধরে হাসপাতালের বেডে কাঁতরাইছে। ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে জেনেও তার পাশে থাকতে পারিনি। কতই না কষ্ট প্যায়ে মারা গেছে। কতই না আর্তনাদ করিছে। এমন কষ্ট আল্লাহ য্যান আর কাউকে না দেয়।’

Advertisement

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডে গুলিতে মারা যাওয়া কিশোর রাসেলের (১৫) বাবা পিন্টু রহমান।

রাসেলের মা অঞ্জনা খাতুন শোকে মুষড়ে পড়েছেন। ছেলে হারানোর শোক সইতে না পেরে বার বার বিলাপ করছেন। পুত্র শোকে মুখে কোনো দানাপানিও নিচ্ছেন না তিনি।

রাসেলের পরিবারের সদস্যরা জানান, গত ১৯ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডের ২ নম্বর গেটের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন রাসেল। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

Advertisement

রাসেলের বুকে একটি গুলি বিদ্ধ হয়েছিল। ২১ জুলাই তার শরীরে অস্ত্রোপচার করে সেই গুলি বের করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জুলাই রাতে মারা যায় রাসেল। তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায় পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে। ওই দিনই তাকে দাফন করা হয়।

রাসেলের বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কশব ইউনিয়নের ভোলাগাড়ী গ্রামে। বাঁশ-খড়ের বেড়া আর টিনের ছাউনির ছোট্ট একটি বাড়ি রাসেলদের। রাসেলের বাবা পিন্টু রহমান দিনমজুর। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট রাসেল। তার এক বোন মানসিক প্রতিবন্ধী।

শনিবার (২৭ জুলাই) দুপুরের দিকে রাসেলদের বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে প্রতিবেশী এক নারী বাড়ির ভেতরে গিয়ে রাসেলের চাচা আব্দুর রশিদকে ডেকে আনেন।

আরও পড়ুন

Advertisement

সহিসংতায় জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে: প্রধানমন্ত্রী সহিংসতায় ১৪৭ জন মারা গেছেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত ৩৪ জনের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তা

আব্দুর রশিদ জানান, রাসেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শোনার পর থেকেই তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মুখে কোনো দানাপানি নিচ্ছেন না। না খেয়ে খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছেন রাসেলের বাবা।

রাসেলের চাচা বলেন, ‘সংসারে অভাবের কারণে রাসেল ক্লাস টু-থ্রি পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলে যায়নি। দেড় বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ আখড়া এলাকায় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ছয়-সাত হাজার টাকা বেতনে কাজ করছিল সে। কোরবানির ঈদের ছুটি শেষে ১২-১৩ দিন আগে নারায়ণগঞ্জে ফিরে যায়। আর এখন সে বাড়ি ফিরে এলো লাশ হয়ে।’

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাসেলের মা অঞ্জনা খাতুনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন বাবা পিন্টু রহমান।

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে পিন্টু রহমান বলেন, ‘১৯ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে ছেলের সঙ্গে হামার শেষ কথা। মা ও বোনেরা ক্যামন আছে, এগুলা খোঁজ নিলো। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাসেলের ফোন থ্যাকে কল আসে। কল ধরার পর অন্য এক লোক জানায়, রাসেলের বুকত গুলি লাগিছে। ঢাকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরমধ্যে শুনি কারফু জারি হয়ে গেছে। ঢাকা যাওয়ার কোনো গাড়ি না পাওয়ায় আর য্যাতে পারিনি।’

পিন্টু রহমান বলেন, ‘হামার ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে জ্যানেও তার পাশে থাকতে পারিনি। একটা মা-বাবার জন্য এর চ্যায়ে চরম কষ্ট আর কি? গুলি লাগিছে শুক্রবার। চার দিন ধরে হাসপাতালের বেডে কাঁতরাইছে। কতই না কষ্ট প্যায়ে মারা গেছে। কতই না আর্তনাদ করিছে। এমন কষ্ট য্যান আল্লাহ আর কাউকে না দেয়।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন পিন্টু রহমান।

কশব ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য ও প্রতিবেশী পাঞ্জব আলী বলেন, ‘রাসেলের বাবা একেবারে গরিব। দিনমজুরি করে কোনো রকম সংসার চালায়। ছেলেটা গার্মেন্টে দেড় বছর ধরে কাজ শিখতেছিল। ছয়-সাত হাজার বেতন প্যায়ে কোনো রকম নিজে চলতে পারতো। আর কিছু দিন গেলে হয়তো কাজ শিখলে বেতন বাড়তো। তখন সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা ফিরতো। কিন্তু তার আগেই সব শ্যাষ হয়ে গেল।’

মনিরুল ইসলাম শামীম/জেডএইচ/এমএমএআর/এএসএম