দেশজুড়ে

চর্ম-জরায়ু সমস্যায় ভুগছেন সাতক্ষীরা উপকূলের নারীরা

দেশের অন্য উপকূলীয় এলাকার তুলনায় সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি। এজন্য ওই এলাকার মানুষকে টিকে থাকতে হয় লোনা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে। এতে পাল্টে যাচ্ছে উপকূলের মানুষের জীবনধারা।

Advertisement

সাম্প্রতিক সময়ে সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চলের শিশু-নারীরা চর্ম ও জরায়ু রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে কাজ করা কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা জরায়ুজনিত সমস্যার জন্য পানির লবণাক্ততাকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণার দরকার আছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী গ্রামের বাসিন্দা বাচ্চু গাজী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এলাকার পানি লবণাক্ত। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত। তবে নিয়মিত চিকিৎসা নিলেও পানির কারণে রোগ সারে না। বিশেষ করে নারীদের বেশিরভাগই জরায়ু সমস্যায় ভুগছেন।’

একই গ্রামের বাসিন্দা মোমেনা বেগম। প্রতিদিন ভাটির সময় নদীতে পোনা শিকার করেন। কয়েক বছর আগে শরীরের বিভিন্ন অংশে দাদে আক্রান্ত হন।অনেক ওষুধ ব্যবহার করেও সারেনি। চিকিৎসক নদীতে না নামার পরামর্শ দিলেও জীবিকার তাগিদে সেটি মানতে পারেন না তিনি।

Advertisement

তবে শুধু মোমেনা বেগম নন, সবসময় লোনা পানিতে থাকা ও ব্যবহারের কারণে তাদের এলাকার অনেক নারীর স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক নারী জরায়ুতে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

উপকূলীয় এলাকায় কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী ওসমান গণি সোহাগ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলে প্রধান সমস্যা লোনা পানি। প্রায় প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে এ অঞ্চলকে লবণাক্ত করে ফেলেছে। এই লবণাক্ত পানির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। যা তাদের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে।

বেসরকারি সংস্থার এ কর্মী বলেন, এখানকার বেশিরভাগ নারী ও শিশু চর্মরোগে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে গায়ের চামড়া উঠে যাওয়া, চুল পড়াসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্মরোগ (ডার্মাটোলজি) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. হরষিত চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, উপকূলীয় এলাকার মানুষ অতিমাত্রার লোনা পানি ব্যবহার করেন। এজন্য ওই এলাকা থেকে যেসব রোগী আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের বেশিরভাগই কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনে আক্রান্ত। এটি হলে ত্বকের এক প্রকার তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ হয়, যা রাসায়নিক বা শারীরিক এজেন্টের সংস্পর্শে আসার কারণে ঘটে। কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিসের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে চুলকানি বা শুষ্ক ত্বক, লাল ফুসকুড়ি, ফুসকুড়ি, ফোসকা হওয়া বা ফুলে যাওয়া। এটি ছত্রাক সংক্রমণ, যা মাইকোসিস নামেও পরিচিত।

Advertisement

তবে শুধু লোনা পানির কারণে নারীদের জরায়ুতে সমস্যা হচ্ছে কি না তা বলার আগে এটি নিয়ে গবেষণার দরকার আছে বলে মনে করেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রহিমা খাতুন।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, লোনা পানির চেয়ে নারীদের জরায়ুর ক্ষতি বেশি হচ্ছে পুওর হাইজিনের (অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের) কারণে। উপকূলীয় এলাকার কিশোরী ও অল্প বয়স্ক নারীরা বেশি জরায়ু সমস্যায় ভুগছেন। সচেতনতার অভাবে ভুল চিকিৎসায় অনেক রোগীর অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটি উচিত নয়।

ডা. রহিমা খাতুন বলেন, ‘অপারেশন না করে রোগীর অবস্থা বিবেচনায় চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। জরায়ু কেটে ফেললে একজন নারী দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হন। কিশোরীদের হরমোনগত নানা সমস্যা দেখা দেয়। প্রতিদিন এমন অনেক রোগী আমার কাছে আসছেন, যাদের জরায়ু কেটে ফেলার পর তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে জরায়ু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা খুব বেশি নয়।’

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য কর্মকর্তা ডা. জয়ন্ত কুমার জাগো নিউজকে বলেন, সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী এলাকার পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ অনেকটা বেড়ে গেছে। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে এসব অঞ্চলের শিশু ও নারীরা চর্ম ও জরায়ুসহ নানা সমস্যায় ভুগছেন।

তিনি বলেন, কিছু বেসরকারি সংস্থা এসব বিষয়ে কাজ করছে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আলাদা কোনো জরিপ বা গবেষণা করা হয়নি।

আহসানুর রহমান রাজীব/এসআর/এমএস