দেশজুড়ে

সর্বস্বান্ত করছে অনলাইন জুয়া

মোবাইল ফোনের বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে পাবনা জেলাজুড়ে অনলাইন জুয়া ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ এতে আসক্ত হচ্ছেন। বেশি আসক্ত হচ্ছেন হাইস্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও তরুণরা। অনলাইন জুয়ার ভয়াল থাবায় ধসে যাচ্ছে সাজানো সংসার, পরিবার। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সমাজপ্রধানরাও থামাতে পারছেন না এ নেশা।

Advertisement

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা সদর থেকে শুরু করে উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে এই জুয়া বিস্তার লাভ করেছে। সহজে প্রচুর টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মানুষ এই জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। তরুণদের অনেকেই কৌতুহলবশত এই খেলা শুরুর পর নেশায় পড়ে যাচ্ছেন। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন।

অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্মার্টফোনে নির্ধারিত কয়েকটি অ্যাপস ডাউনলোড করে সেখানে জুয়া খেলা চলে। বিভিন্ন নামের প্রায় ১০ থেকে ১২টি অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি জুয়া খেলা হয়। এসব অ্যাপসে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো অঙ্কের টাকা দিয়ে শুরু করা যায়। অ্যাপসগুলোর বেশির ভাগই পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।

বাংলাদেশে এগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধি (এজেন্ট) রয়েছেন। বিভিন্ন এলাকার প্রায় বাজারেই রয়েছেন এজেন্ট। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ বা প্রদান করে থাকেন। এজেন্টরা বিদেশি অ্যাপস পরিচালনাকারীদের কাছ থেকে হাজারে কমপক্ষে ৪০ টাকা কমিশন পান। এজেন্টদের মাধ্যমেই বিদেশে টাকা পাচার হয়।

Advertisement

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, এসব খেলা স্বাভাবিক গেমের মতো হওয়ায় প্রকাশ্যে খেলা হলেও আশপাশের মানুষ তা বুঝতে পারেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাবনার সাঁথিয়ার এক কলেজ শিক্ষার্থী বলেন, প্রথমে ৩৬ টাকা বিনিয়োগ করে ১৬ হাজার টাকা পান তিনি। এতে লোভে পড়ে এই খেলায় মারাত্মক আসক্তি চলে আসে তার। এই জুয়ার নেশায় পড়ে ছয় মাসে মোটরসাইকেলও বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি।

একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাকিল বলেন, ‘মোবাইলে গেম ও জুয়া খেলতে খেলতে আমার এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার টাকা চলে গেছে। কোনো লাভ হয়নি। উল্টো পড়ালেখার ক্ষতি হয়েছে। চোখেরও ক্ষতি হয়েছে।’

বাড়ছে পারিবারিক কলহ

সাঁথিয়া উপজেলার গৌরীগ্রাম ইউনিয়নের এক নারী বলেন, তার স্বামী অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কলহ দেখা দেওয়ার একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের।

Advertisement

একই অবস্থা পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের কুদ্দুস আলীর ছেলে শাহীনের। প্রায় ১৬ বছর আগে পারিবারিকভাবে শাহীনের সঙ্গে বিয়ে হয়। তাদের ১০ ও ১২ বছরের দুইটি সন্তান রয়েছে। জুয়ার নেশায় সব হারিয়ে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর স্ত্রীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

পাবনার বেড়া উপজেলার পুরান ভারেঙ্গা ইউনিয়ন ও নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়নে অনলাইন জুয়ার ভয়ঙ্কর চিত্র দেখা যায়।

পেশায় রিকশাচালক এক জুয়াড়ি জানান, এমন জুয়া খেলা কেউ ধরতে পারবে না। আমরা সারাদিন ভ্যান-রিকশা চালিয়ে সন্ধ্যায় বসে যাই। জুয়া একটা মজার ব্যাপার। এটা এমন নেশা যে, খেলা শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে ততক্ষণ খেলতে ইচ্ছা করে। তবে দ্রুতই নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়, ভিটেমাটিও বিক্রি করতে হয় বলে ওই জুয়াড়ি স্বীকার করেন।

পাবনা পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড শালগাড়ীয়া ফরেস্টের পাশে গিয়ে দেখা যায়, এলাকার প্রতিটি দোকানে সাত-আটজন কিশোরের প্রত্যেকের হাতে স্মার্টফোন। তারা প্রত্যেকেই মগ্ন অনলাইন গেম ও জুয়া খেলায়।

পাবনা পৌর সদরের শালগাড়ীয়া মহল্লায় ঘুরে দেখা যায়, এলাকার দোকান, ভবন, গাছতলা কিংবা সড়কের বিভিন্ন স্থানে দিনের প্রায় সব সময়ই দেখা মেলে এ রকম দলবদ্ধ কিশোর-তরুণদের। এসব জায়গায় নিয়মিতই বসে অনলাইন গেম ও জুয়ার আসর।

স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা জানালেন, দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়ই এসব কিশোর-তরুণের চলে যাচ্ছে এই নেশার পেছনে। পড়ালেখা, খেলাধুলা, কাজকর্ম কিছুতেই তাদের মন নেই। অনেকেই পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে। কেউ কেউ অনলাইন জুয়ায় টাকা জিতলেও হারছে বেশি। সেই টাকা জোগাড় করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে।

জুয়ার স্থানীয় এজেন্টদের বিরুদ্ধে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা মাঝে মধ্যে অভিযান চালায়। গত বছরের ২৪ জুলাই পুলিশের জেলা গোয়েন্দা শাখা অভিযান চালিয়ে সাঁথিয়া উপজেলার সাটিয়াকোলা পূর্বপাড়া গ্রাম থেকে অনলাইন জুয়া ব্যবসায়ী নাহিদুল মোল্লাকে গ্রেফতার করে। এরপর তেমন কোনো অভিযান চোখে পড়েনি। এমন অভিযান প্রতি সপ্তাহে চালানো দরকার বলে স্থানীয়রা মত দেন।

অনলাইন জুয়ার ব্যাপারে পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেদায়েতুল হক বলেন, যেভাবে অনলাইন জুয়ার বিস্তৃতি বাড়ছে তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। শহরাঞ্চল থেকে শুরু করে তাদের চলনবিল এলাকার প্রত্যন্ত জনপদেও অনলাইনে জুয়া খেলা বাড়ছে।

তিনি বলেন, প্রশাসনিক বা সামাজিক উদ্যোগের চেয়ে পারিবারিক সচেতনতা বেশি জরুরি। কারণ কে গোপনে অনলাইনে জুয়া খেলছে তা প্রশাসনের লোকজনতো দূরের কথা প্রতিবেশীরাও শুরুর দিকে টের পান না। যখন কোনো পরিবার ধসে যায় বা কারো সংসারে ভাঙন দেখা দেয় তখন বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এটা বন্ধের জন্য জুয়ার সব অ্যাপ ব্লক করার বিকল্প নেই।

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মাসুদ আলম বলেন, পাবনায় এ বিষয়ে বেশ কিছু মামলা চলমান আছে। অনলাইন ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপে খেলে কেউ নিঃস্ব হয়েছে, কেউ অনেক টাকা পেয়েছে। এসব জুয়ার টাকা খুব সহজেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হাতবদল করা যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় আছে। অনলাইন জুয়ার সফটওয়্যার ডেভেলপার এর আগে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। অনলাইনে জুয়া বন্ধে পাবনা জেলা পুলিশ নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

এফএ/জেআইএম