অর্থনীতি

ব্যবসা-বাণিজ্যে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’

টানা পাঁচদিন অচলাবস্থার পর বুধবার সকাল থেকে দেশের পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। বুধবার (২৪ জুলাই) সকাল থেকে কারফিউ শিথিল থাকায় বাজারঘাট, ব্যাংক খুলেছে, সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের ভিড় বেড়েছে। তবে জুলাইয়ের প্রথমদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুর সময় থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে।

Advertisement

কোটা সংস্কার নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির পুরো সময়ই বেচাকেনা কম ছিল। ঢাকার অধিকাংশ মার্কেট ও শপিংমলে ক্রেতার খরা ছিল। জরুরি অবস্থা জারির পর এ খাতে পুরোপুরি অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

এ সময়ে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান সারাদেশে ঠিকমতো পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি। আমদানি-রপ্তানিসহ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বেশিরভাগ সেবা-পরিষেবা স্থবির হয়ে পড়ে। ক্ষুদ্র ব্যবসাও অচলাবস্থার কবলে পড়ে। তাদেরও ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ হয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য কদিন বন্ধ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তবে হঠাৎ সব অচল হয়ে যাওয়ায় আগে থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। ইন্টারনেট-ব্যাংক বন্ধ থাকায় পাঁচদিন লেনদেন ছিল শূন্যের কোটায়। বিক্রি না হওয়ায় মালামাল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি কাঁচামাল পচে যাওয়া ও খাদ্যদ্রব্য মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।

Advertisement

এদিকে দেশের কিছু কলকারখানা বুধবার খুললেও আগে বন্দর থেকে কাঁচামাল খালাস না হওয়ায় অনেকে পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছে না। কাঁচামাল না পেলে কোনো কোনো কারখানার উৎপাদনে যেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। যে কারণে কারখানাগুলো অন্য পণ্য কিনতে এখনো সরবরাহ আদেশ দিতে পারছে না।

আরও পড়ুন

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ৫ দিনে ই-কমার্সে ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা ইন্টারনেট বন্ধের মধ্যে যা যা হলো রামপুরা থেকে গুলিস্তান সড়ক ফাঁকা, দোকানপাটও বন্ধ

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব মিলিয়ে ব্যবসায় এখনো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরছে না। অনেকে এখনো দোকানপাট খোলেননি। যারা খুলছেন, তারাও আশানুরূপ ক্রেতা পাচ্ছেন না।

ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের মেলা ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী শফিউল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও অনেক সময় লাগবে। এখানো অনেকে ভয়ে মার্কেটে আসছেন না। এই এলাকায় বেচাকেনার পরিবেশ এখনো ফেরেনি। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে এ অবস্থা। এর মধ্যে গত পাঁচদিন মার্কেট একদম বন্ধ ছিল।’

Advertisement

শুধু শফিউল নন, এ মার্কেটসহ পল্টন, গুলিস্তান, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট ও আশপাশের বেশ কয়েকটি মার্কেটের দোকান মালিকরা জানান, এসব মার্কেটের অধিকাংশ দোকানে ক্রেতা না থাকায় এখনো বিক্রি শুরু হয়নি। দিন দিন তাদের লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে।

এদিকে দোকান মালিক সমিতি জানিয়েছে, বুধবার ঢাকায় সব বিপণি-বিতান খোলা থাকবে। কারফিউয়ের বিরতিতে বেচাকেনা চলবে। অর্থাৎ সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত যে সময়ে কারফিউ শিথিল থাকবে, সেই সময়ে বিপণি-বিতানগুলো খোলা থাকবে। তবে এসব এলাকায় এখনো সব দোকান খোলেনি।

নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী কাইয়ুম বলেন, ‘বিক্রি একেবারেই নেই। দোকান খুললেও ক্রেতা আসেননি। পরিস্থিতি স্বভাবিক হতে সময় লাগবে।’

এদিকে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সারাদেশে দোকান বন্ধ থাকায় বড় ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ এখনই সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে অন্য সময়ে একদিন দেশের দোকান বন্ধ থাকলে দিনে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তবে এবারের ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। অনেক দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

এদিকে দিনের কিছু সময় কারফিউ শিথিল থাকলেও সার্বিকভাবে ঢাকার বাজারে মানুষের আনাগোনা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম। সাধারণ মানুষ এখনো প্রয়োজন ছাড়া বাইরে তেমন যাচ্ছেন না।

আরও পড়ুন

খাতুনগঞ্জে বেড়েছে ভোজ্যতেল-চিনির দাম আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আরও এগিয়ে যেতে চাই: আহসান খান চৌধুরী ব্যাংকে উপচেপড়া ভিড়, জমার চেয়ে উত্তোলন বেশি

মালিবাগ মোড়ের একটি কনফেকশনারির মালিক ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, ‘এখন কোনো আন্দোলন না হলেও বিক্রি নেই। আগে প্রতিদিন সাত থেকে নয় হাজার টাকা কেনাবেচা হতো, এখন তা কমে এসেছে দু-তিন হাজারে।’

ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার, চকবাজার, নবাবপুর, ইংলিশ রোড, বাদামতলী, বাবুবাজার, ওয়াইজঘাট ও সোয়ারীঘাট। সব রকমের নিত্যপণ্য, কাঁচামাল, ইলেকট্রনিক্স পণ্যসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের একটি বড় অংশই সরবরাহ হয় এখানকার আড়তগুলো থেকে। প্রায় সারাদেশের দোকান, কারখানায় কাঁচামালের জোগান দেন এখানকার ব্যকসায়ীরা।

বুধবার দুপুরে এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেশকিছু দোকান খোলা থাকলেও এখনো এক রকম স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। নবাবপুর থেকে ইংলিশ রোডে দেখা মেলে না আগের সেই ভিড়। ক্রেতা সমাগম কম। অনেক বিক্রেতা অলস সময় পার করছেন।

নবাবপুরের হার্ডওয়ার ব্যবসায়ী লাল মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায় ধস নেমেছে। ভয়ে ঢাকার বাইরে থেকে লোকজন আসছেন না। মাত্র রাস্তা খুলেছে, স্বাভাবিক হতে আরও কিছুদিন লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘বড় কোনো অর্ডার নেই। টেলিফোনে কিছু অর্ডার আসছে। কিন্তু গাড়িতে পাঠানো যাচ্ছে না। রিকশা আছে। কুরিয়ার সার্ভিসও বন্ধ। মাল পাঠানো যাচ্ছে না।’

ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার মৌলভীবাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে এ সময় কথা হয়। তারাও অপূরণীয় ক্ষতির কথা জানান। কারও কারও ক্ষতি হাজারের অংকে, কারও কারও লাখে।

আরও পড়ুন

স্বস্তি ফিরছে জনমনে দ্রুত কারফিউ তুলে দিতে কাজ করছে সরকার: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সড়কে যানজট, গণপরিবহন সংকটে নাজেহাল সাধারণ মানুষ

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বশির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অনেকের মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কোনো ক্রেতা নেই। কোটি কোটি টাকার পণ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। লোনের চাপ প্রতিদিন বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘এখানে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার বেচাবিক্রি হয়। গত পাঁচদিনে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি। এর আগেও দুই সপ্তাহ বিক্রি হয়নি।’

অন্যদিকে সারাদেশের বিভিন্ন বন্দরের কার্যক্রম মঙ্গলবার পর্যন্ত পুরোপুরি বন্ধ ছিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সারাদেশের ৪৩টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ছয় হাজার চালান পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ হিসাব আমলে নিলে গত তিনদিনে প্রায় ১৮ হাজার চালান বন্দরে আটকা রয়েছে।

আবার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় পণ্য রপ্তানিও করা যায়নি। একই সঙ্গে আমদানি করা পণ্যের শুল্কায়নও করা যায়নি। বর্তমানে বন্দরে সব পণ্য কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড অটোমেশনের মাধ্যমে খালাস করা হয়। পরে ব্যবসায়ীদের অনুরোধে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কিছু পণ্য খালাসের নির্দেশ দেয় এনবিআর। মঙ্গলবার থেকে শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্য ও পচনশীল পণ্য খালাস করা যাচ্ছে। তবে আটকা পণ্যের তুলনায় এ সংখ্যা নগণ্য।

এনএইচ/ইএ/এএসএম