দেশজুড়ে

দুর্বৃত্তদের আগুনে ধ্বংসস্তূপ ‘প্রিয়ম নিবাস’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুলাই থেকেই উত্তপ্ত ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জ অংশ। ওইদিন মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকলেও তেমন নাশকতামূলক ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ১৯ জুলাই থেকে মহাসড়কে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে দুর্বৃত্তরা। ২০ জুলাই মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাংরোড এলাকায় ‘প্রিয়ম নিবাস’ নামের এক বহুতল ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। এসময় আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভেতরে আটকা পড়া মানুষদের বের হওয়ার প্রবেশদ্বার তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়।

Advertisement

এ ঘটনায় দগ্ধ অবস্থায় তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। বাকিদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। ভবনটির পরতে পরতে এখন ধ্বংসস্তূপের চিহ্ন।

সরেজমিন জানা যায়, ৯তলাবিশিষ্ট ভবনটির নিচতলায় জামা-কাপড়ের দোকানসহ মুদির দোকান ও কয়েকটি গুদাম ছিল। দ্বিতীয়তলায় ব্যাটারি, সাইকেল, ইলেকট্রিকের দোকানসহ বিভিন্ন অফিস ছিল। তৃতীয় তলায় ডাচ বাংলা ব্যাংক, চতুর্থ তলায় তাজমহল রেস্টুরেন্ট, পঞ্চম তলায় মা হাসপাতাল, ষষ্ঠ তলায় এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড, সপ্তম ও অষ্টম তলায় ছিল কাঁচপুর হাইওয়ে থানার শিমরাইল ক্যাম্পের পুলিশের ক্যাম্প। ভবনে আটকে পড়া ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে ভবনের দ্বিতীয় তলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন ধীরে ধীরে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। তবে দোকানগুলো বন্ধ থাকায় ভবনের ওপরের তলায় থাকা লোকজন আগুনের বিষয়টি শুরুতে টের পাননি। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দ্বিতীয় তলা থেকে সৃষ্ট কালো ধোঁয়া ওপরে ছড়িয়ে পড়ে।

খবর পেয়ে আদমজী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের দুটি ইউনিট একাধিকবার আগুন নেভানোর জন্য বের হওয়ার চেষ্টা করলেও অবরোধকারীদের হামলায় তাদের বারবার পিছপা হতে হয়। এসময় ভবনে আটকে থাকা মানুষজন বাঁচার জন্য আর্তনাদ করতে থাকলেও কালো ধোঁয়ার কারণে তারা ভবনটি থেকে বের হতে পারছিলেন না। পরে বিকেলের দিকে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে তাদের উদ্ধার করে। কথা হয় শিমরাইল ক্যাম্পের টিআই একেএম শরফুদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, ওইদিনের ভয়াবহ চিত্র আজও ভুলতে পারেননি। তার ভাষ্য, ‘আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পর প্রবেশদ্বারের গেটগুলো খোলা থাকলেও আমরা সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু দুর্বৃত্তরা গেট লাগিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি পুরো ভবনটি ঘিরে রাখে। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস আমাদের রক্ষা করতে না পারে। মূলত আমাদের হাইওয়ে পুলিশের ক্যাম্পকে উদ্দেশ্য করেই দুর্বৃত্তরা এই হামলা চালিয়েছিল। আমরা যেন প্রাণে বাঁচতে না পারি সবরকম চেষ্টা তারা করেছিল। ভেতরে আমিসহ ৩৬ জন পুলিশ সদস্য আটকে পড়েছিলাম। আর কিছুক্ষণ ভেতরে থাকলেই আমাদের সবাইকে মৃত্যুবরণ করতে হতো। এ ঘটনায় আমাদের পক্ষ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করা হবে।’ আদমজী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার মিরন মিয়া বলেন, ‘আগুনের খবর পেয়েই আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু হামলাকারীরা রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্ট বন্ধ করে রাখে। আমরা বের হলেও আমাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরে বিকেলের দিকে আমরা ঘটনাস্থলে যেতে সক্ষম হই। তখন ভেতরের মানুষদের উদ্ধার করতে পারলেও হামলাকারীদের কারণে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এসময় আমাদের গাড়িতেও হামলা করা হয়।’

Advertisement

এদিকে আগুনের ঘটনার পরদিনও ভবনটির বিভিন্ন স্থানে থেমে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। পরে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আশপাশের সাধারণ মানুষ পানি দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। এসময় আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দোকান থেকে মালামাল লুট করা হয়। পরে ২২ জুলাই ভবনটির ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হলে তৃতীয় তলার ডাচ বাংলা ব্যাংকের ভেতর থেকে দগ্ধ অবস্থায় তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

তারা হলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর জগন্নাথপুর এলাকার ওহাব মন্ডলের ছেলে সেলিম মন্ডল (২৯), একই এলাকার মৃত সাবের বিশ্বাসের ছেলে আব্দুল সালাম (২২) ও সিলেটের বিয়ানীবাজারের কাবুরা এলাকার সোহেল আহমেদ (২১)। তারা প্রত্যেকেই পেশায় মিস্ত্রি ছিলেন। আগুন দেওয়ার দিন তারা ডাচ বাংলা ব্যাংকের ভেতর ডেকোরেশনের কাজ করছিলেন। এসময় তাদের সঙ্গে থাকা আরও চারজন বের হতে পারলেও তারা তিনজন বের হতে পারেননি।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নিহতদের শরীরের বেশিরভাগ অংশ না পুড়লেও অতিরিক্ত কালো ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টে তাদের মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় ভবনটিতে থাকা বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের প্রায় ১৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যায়।

Advertisement

ভবনটিতে ‘তাজমহল’ নামের একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। রেস্তোরাঁটির মালিকপক্ষের একজন রাজিব বলেন, ‘আমার রেস্তোরাঁর বেশিরভাগ জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এটি পুনরায় চালু করতে অনেক অর্থ ও সময় লাগবে।’

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

রাশেদুল ইসলাম রাজু/এসআর/এএসএম