সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরির সব গ্রেডে কোটা রাখা হয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। অন্যদিকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে ৯৩ শতাংশ।
Advertisement
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সর্বোচ্চ আদালতে সামগ্রিকভাবে বাতিলের পর মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্ব-শাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে বা কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংশোধন।’
এতে বলা হয়, সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব লাভ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থাৎ সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্ব-শাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরিতে বা কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সব গ্রেডে যে কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে, মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনার সন্তানের জন্য পাঁচ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এক শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ।’
Advertisement
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘এছাড়া নির্ধারিত কোটায় যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলোতে সাধারণ মেধা তালিকা হতে পূরণ করা হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-১ শাখার বিগত ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবরের পরিপত্র নম্বর ০৫.০০.০০০০.১৭০.১১.১৮-২৭৬-সহ পূর্বে জারিকৃত সব পরিপত্র/প্রজ্ঞাপন/ আদেশ/নির্দেশ/অনুশাসন রহিত করা হলো। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হবে।’ রোববার (২১ জুলাই) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে রায় দেন যে, এ নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন ও সংস্কার করতে পারবেন।
কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের রায়প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি (লিভ টু আপিলের) চেয়ে করা পৃথক পৃথক আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে রোববার (২১ জুলাই) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ রায় দেন।
আদালতে ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মুহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন। রিটকারীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন শাহ মুঞ্জুরুল হক। আদালতে অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এএমএফ হাসান আরিফ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম,ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম ও অ্যাডভোকেট মো.জহিরুল ইসলাম (জেডআই) খান পান্না।
তাদের শুনানি শেষে আদালত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা নতুনভাবে বণ্টন করে আদেশ দেন। এতে বলা হয়, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানের জন্য পাঁচ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য এক শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ কোটা থাকবে। বাকি ৯৩ শতাংশ নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। রায় কার্যকরে অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা দেন আপিল বিভাগ। সার্বিক বিবেচনায় সরকার চাইলে প্রয়োজনে এটি সংযোজন, বিয়োজন ও বাতিল করতে পারবেন বলে জানান আপিল বিভাগ।
Advertisement
এর আগে, রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের বিশেষ চেম্বার জজ আদালত শুনানির জন্য এদিন ঠিক করেন। যদিও এর আগে গত ১০ জুলাই এ বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ৭ আগস্ট দিন ঠিক করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
এর মধ্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি এগিয়ে আনা হয়। ১৮ জুলাই আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত পূর্ণাঙ্গ ও নিয়মিত বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানির জন্য ২১ জুলাই দিন ঠিক করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ওইদিন শুনানি নিয়ে আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
এর আগে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফাইড কপি পেয়ে ১৬ জুলাই আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিলের অনুমতি চেয়ে রাষ্ট্র লিভ টু আপিল করেছেন বলে সাংবদিকদের জানান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
১৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ২৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। সে রায়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি, নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি–ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটাসহ (যদি অন্যান্য থাকে) সব কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
তবে হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, ‘প্রয়োজনে উল্লেখিত শ্রেণির ক্ষেত্রে কোটা পরিবর্তন ও হার কমানো বা বাড়ানোর বিষয়ে এ রায় বিবাদীদের জন্য কোনো বাধা তৈরি করবে না। যেকোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোটাপূরণ না হলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করায় বিবাদীদের স্বাধীনতা রয়েছে।’
এদিকে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া এই রায় স্থগিত চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগ কোটা নিয়ে আইনি বিরোধের বিষয়বস্তুর ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাসকো) দেন। সেই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল (সিপি) করতে বলা হয় এবং পরবর্তী আদেশের জন্য ৭ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগে সব ধরনের কোটা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়েছিল, ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেড (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাতালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। যেখানে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৫ ও প্রতিবন্ধীর ১ শতাংশ কোটা বাতিল করা হয়।
এই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন হাইকোর্টে রিট করেন। সে রিটের শুনানি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সে রুল যথাযথ ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ বলে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের এই রায়ের পর সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের এক পর্যায়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এএএম/এফএইচ/এমআরএম/এমএমএআর