প্রবাস

মানুষের জন্য কতভাগ কোটা

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সাল থেকেই সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ও নারী কোটা ছিল। প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ মেধা এবং বাকি ৮০ শতাংশ জেলা কোটা রাখা হয়। এই ৮০ শতাংশ জেলা কোটার মধ্য থেকেই ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০ শতাংশ কোটা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগই ছিল সমাজের পিছিয়েপড়া কৃষক, শ্রমিক, মজুর, তাঁতি অর্থাৎ নিম্নবর্গের মানুষ। এইসব মানুষদের পরিবার যেন উন্নতি করতে পারে সেজন্যই কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল।

Advertisement

এরপর ১৯৭৬ সালে কোটা বণ্টনে পরিবর্তন আনা হয়। তখন মোট কোটার ৪০ শতাংশ মেধা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং বাকি ১০ শতাংশ কেবলই জেলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৫ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের কোটায় অন্তর্ভুক্ত করে কোটা পদ্ধতির আবারও সংশোধন করা হয়। মেধাভিত্তিক কোটা হবে ৪৫ শতাংশ এবং জেলাভিত্তিক কোটা হবে ৫৫ শতাংশ। এই জেলাভিত্তিক কোটার মধ্যে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ, নারীদের ১০ শতাংশ এবং উপ-জাতীয়দের জন্য ৫ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া না গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যার জন্য তা বরাদ্দের আদেশ জারি করা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য ২০০২ এবং ২০০৮ সালে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এরপর কোটায় পরবর্তী পরিবর্তন আসে ২০১১ সালে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ২০১২ সালে কোটায় প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ বরাদ্দ করা হয়।

কোটা আন্দোলন প্রথমবারের মতো বড় আকারে রূপ নেয় ২০১৮ সালে। টানা আন্দোলন কর্মসূচির মুখে সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা। ২০২১ সালে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। গত পাঁচই জুন তাদের পক্ষে রায় আসে, অর্থাৎ আগের মতো কোটা বহাল হবে বলে আদালত জানিয়ে দেয়।

এর মধ্যে পহেলা জুলাই থেকে শিক্ষার্থীরা বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা বাতিলের আন্দোলনে নামে। এখনো এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বিবিসি বাংলার বিশ্লেষণে এই হচ্ছে মোটামুটি কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং কোটা আন্দোলনের সার ইতিহাস।

Advertisement

আমি আসলে এই ইতিহাস ঘাঁটার পক্ষপাতি না। আমার নিজস্ব বক্তব্য হচ্ছে সবকিছুর আগে বাস্তবতা বিচার করা। এই আন্দোলনকে সরকার শুরু থেকেই আমলে নেয়নি। যেমনটা পৃথিবীর সব ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল করে থাকে। তারা ভেবেছিল একটা সময় ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ কমে আসলে আন্দোলনে ভাটা পড়ে যাবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আন্দোলন স্তিমিত না হয়ে আরো বেগবান হয়েছে। অন্তর্জালের সহজ যোগাযোগ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা সেই আন্দোলন বাংলাদেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। আর তখনই সরকারের টনক কিছুটা হলেও নড়েছে।

তারা তখন তাদের পেটোয়া ছাত্র সংগঠনকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদেরকে শায়েস্তা করতে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশের সহায়তায় শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কতশত শিক্ষার্থী যে আহত হয়েছে তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীসহ ছয়জন মানুষ মারা গেছে। শিক্ষার্থী ছাড়া যেকজন মারা গেছেন তারা সবাই খেটে খাওয়া মানুষ।

আর আমরা এটা খুব ভালো করেই জানি একজন খেটে খাওয়া মানুষ একটা পরিবারের খুঁটি। এছাড়াও যেসব ছাত্র মারা গেছে তাদের পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা তো তাদের সন্তানকে পড়াশোনা করে পরিবারের হাল ধরার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই সন্তান ফিরেছে লাশ হয়ে। এরচেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ছাত্র আন্দোলন জোয়ারের পানির মতো। শুরুটা যেভাবেই হোক এরপর যখন জোয়ারে প্লাবিত হতে শুরু করে তখন তার সামনে কোন বাঁধায় আর টিকতে পারে না। এখনকার ছাত্র আন্দোলন ঠিক সেই উত্তাল জোয়ারের পানি যার প্রবাহে সারাদেশ প্লাবিত হচ্ছে। শুরুতে সেই প্লাবন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন এটা প্রায় প্রত্যেক পরিবারে নেমে এসেছে।

কারণ নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চমাধবিত্ত সকল পরিবারের সন্তানই স্বপ্ন দেখে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি করার। চাকরিটা কেন সরকারি হতে হবে সেই আলোচনা এখানে মুখ্য না তাই সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না।

Advertisement

শিক্ষার্থীদের আন্দলোনের একটা পর্যায়ে তারা নিজেদের রাজাকার দাবি করে স্লোগন দিয়েছে। আমি আপনি যেহেতু সেই মিছিলে ছিলাম না তাই মোটাদাগে তাদের এমন স্লোগান নিয়ে কোনো সরল মতামত দিতে পারি না। তবে খুব সহজেই অনুমান করা যায় তারা কেন এমন একটা স্লোগান দিয়েছে। ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগ এবং তাদের ছাত্রসংগঠন নিজেদের দলীয় অপর্কম ঢাকতে রাজাকার ট্যাগটা সবসময়ই ব্যবহার করে।

যাদেরই মতো তাদের সাথে মিলে না সে যে দলেরই বা ধর্মেরই হোক তাকে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে দেয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের এই ট্যাগ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ পর্যন্ত রেহাই পায় নাই। আরো দুঃখজনক হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল দাবি করা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সংখ্যালঘুদের ওপর অন্যায় অত্যাচার বেড়ে যায়। এটা অনেকটা বেড়ায় ক্ষেত খেয়ে ফেলার মতো ব্যাপার।

শিক্ষার্থীরা যেই নিজেদের রাজাকার দাবি করেছে সেই দেশের প্রধান থেকে শুরু করে শিক্ষক এমনকি সংখ্যালঘুরা গেল গেল রব তুলেছে। কিন্তু কেউই এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করছে না। প্রধানমন্ত্রী ১৫ জুলাই তার কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও লাগে না।’ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন তাদের সব ক্ষমতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছে। শিক্ষকদের আমরা জাতির বিবেক বলে অভিহিত করি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই এই আন্দলোনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল যাকে আমরা বাংলাদেশের বিবেক বলে জানি তিনি পর্যন্ত ছাত্রদের এই আন্দোলনকে ভালো চোখে দেখছেন না। তিনিও প্রধামন্ত্রীর সাথে সুর মিলিয়ে বলেছেন, আমি কোনো রাজাকারের মুখ দেখতে চাই না। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে উনি এমন মন্তব্য করেছেন জেনে আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম অবশ্য অবাক হইনি কারণ তার ইদানিংকার কর্মকান্ড দেখে কেন জানি তাকে সরকারের তল্পিবাহক মনে হয়। উনি একই ধরনের কাজ করেছিলেন ২০২২ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়।

যাইহোক যুগের বাস্তবতায় একটা যৌক্তিক আন্দোলনকে সরকার বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা না করে গায়ের জোরে মোকাবিলা করতে চাইছে। এটা দেখে পাকিস্তান আমলের সরকারগুলোর কর্মকাণ্ডের কথা মনে পড়ে যায়। তখন ছাত্ররা কিছু করলেই তাদের কর্মকাণ্ডকে সরকারি বিরোধী আখ্যা দিয়ে কঠোরভাবে দমন করা হতো।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পঁচিশে মার্চ রাতের অপারেশন সার্চলাইট অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল ছাত্র নিধন। কারণ তারা জানতো ছাত্রদের দমন করতে পারলে অন্যরা এমনিতেই থেমে যাবে। কারণ ছাত্ররা প্রাণের মায়া করে না। তারা আন্দোলন সংগ্রামের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে সদা প্রস্তুত।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন আর তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জন্ম হয়েছিল সেখানে এখনও সেই একই চরিত্রের সরকার বিদ্যমান। যেকোনো ভিন্ন মতামতকে ট্যাগ দিয়ে তারা থামিয়ে দিতে চায়। মুক্তিযোদ্ধারা স্বপ্ন দেখেছিল এমন একটা দেশের যেখানে সবাই সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে।

আমি হলফ করে বলতে পারি এখন যেসব মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন তারাও এই আন্দোলনের পক্ষ নেবেন। কারণ তারা তো সমতায় চেয়েছিলেন উপরন্তু তারা তো কোন কিছু পাওয়ার আশায় যুদ্ধে যাননি। তাই একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কাছে দেশের মানুষের স্বার্থই সবার ওপরে স্থান পায়।

সরকার এরই মধ্যে এই আন্দোলনকে বানচাল করতে সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমার ধারণা এতে করে আন্দোলন আরও বেগবান হবে। এবারের আন্দলোনের একটা দিক খুবই উল্লেখযোগ্য। সেটা হচ্ছে আন্দোলনটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুরু করলেও এখন সেটাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছে।

আসলে অধিকারের প্রশ্ন সবাইকে একই কাতারে নামিয়ে এনেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে। জানি না সামনে আরো কি কি কাণ্ড দেখতে হবে। সব দেখে শুনে সত্যজিৎ রায়ের ছবি হীরক রাজার দেশের কথা মনে পড়ে যায়।

হয়তোবা একদিন এই আন্দোলনের যৌক্তিক একটা সমাধান আসবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যে বিভীষিকাময় অজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলো এবং যাচ্ছে সেটা থেকে কি তারা সারাজীবনেও বেরিয়ে আসতে পারবে। এই মানসিক আঘাতের ক্ষত কি কোনো দিনও সেরে উঠবে। আর যে মানুষগুলো মারা গেল তাদের পরিবারের কি হবে।

তারা কি কখনও ভুলতে পারবে এই জঘন্যতম মৃত্যুর ঘটনা। আসলে আমরা মানুষের জন্য আমাদের বিবেকের কতভাগ কোটা বরাদ্দ রেখেছি। আমরা কি মানবিকভাবে কোন বিষয়কে বিবেচনা করে সেটার সমাধান করতে পারি না? কবির সুমনের একটা গানের কথা লেখার শুরু থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেটা দিয়েই লেখাটা শেষ করি-

‘কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষেবড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে?’

এমআরএম/এএসএম