ক্যাম্পাস

প্রতিটি হত্যা-নির্যাতনের বিচার করতে হবে: গীতি আরা নাসরীন

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার ঘটনা তদন্ত করে বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন।

Advertisement

তিনি বলেন, কোটা সংস্কারের দাবি জানানো শিক্ষার্থীদের ওপর যে হত্যা-নির্যাতন চালানো হয়েছে, তার প্রতিটির বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যারা শিক্ষার্থীদের হত্যা-নির্যাতনের সম্মুখীন করেছেন, তাদেরও বিচার করতে হবে। যারা নিহত হয়েছেন, তাদের কোনো কিছু দিয়েই ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। তারপরও তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আহতদের চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর দায়িত্ব নিতে হবে।

বুধবার (১৭ জুলাই) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে আয়োজিত নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এ সমাবেশের আয়োজন করে।

গীতি আরা নাসরীন বলেন, গত কয়েক দিনে শিক্ষার্থীদের রক্তে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়- ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এটি বলা হয়েছিল। আজকে ১৭ জুলাই ২০২৪, আজও যখন এ কথা বলা হচ্ছে, তখন স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের কাছেও তা যৌক্তিক ও পরিচিত লাগছে।

Advertisement

আরও পড়ুন দিনভর সংঘর্ষে প্রাণ গেলো ৬ জনের অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঢাবি, ৬টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ

তিনি বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরেও শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন নেমে আসছে। রংপুরে নিহত আবু সাঈদের মাকে আহাজারি করে বলতে হচ্ছে, ‘তোরা হামার ছাওয়ালের চাকরি দেবু না তো মারলু কেন?’ এ প্রশ্নের কী জবাব দেবেন? হাসপাতালে স্ট্রেচারে শুয়েও প্রতিবাদী শিক্ষার্থীর প্রশ্ন, ‘আমাদের রাজাকার বলা হলো কেন?’ এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

ঢাবির এ অধ্যাপক আরও বলেন, দেশের সর্বত্র বৈষম্য। শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চিত। এ সময়ে শিক্ষার্থীরা কখন, কোন শব্দ বলছেন, স্লোগান দিচ্ছেন, তা নিয়ে যারা বিবৃতি দেন, আপনারা তাদের অধিকারের ভাষা বোঝেন না। তাদের পালস বোঝেন না, তাদের কষ্টটাও বোঝেন না।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ যখন হাহাকার করছে, যখন প্রতিদিন, প্রতিরাতে দেশ লুট হয়ে যায়, শিক্ষার্থীরা তখন কী মনে করেন? তারা স্মরণ করেন ঊনসত্তরের শহীদ শামসুজ্জোহাকে। আপনাদের চেহারা কেন মনে আসে না তাদের? শিক্ষকদের কথা কেন মনে আসে না? কারণ, আপনারা তাদের অধিকার লুণ্ঠনে ব্যস্ত।

ছাত্রলীগের হামলার নিন্দা জানিয়ে গীতি আরা নাসরীন বলেন, শিক্ষার্থীরা আজকে মাথায় পতাকা বেঁধে দাবি আদায়ে রাস্তায় যায়, পতাকা দোলাতে দোলাতে যায়। তাদের তোমরা যারা মারো, তাদের হাতে দেখি লাঠি, রড, হকিস্টিক ও অস্ত্রশস্ত্র। সবকিছুই তো দেখেছি।

Advertisement

দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলে এ অধ্যাপক বলেন, পাকিস্তান তো অন্য একটি দেশ ভেবে আমাদের শোষণ করেছে। আমাদের দেশের মধ্যে যারা শোষণ করে অন্য দেশে গিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে, আপনারা তাদের ধরেন না। যারা এগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারাই আজ রাজাকার।

সরকারের উচ্চপদে থাকা দায়িত্বশীলরা শপথভঙ্গ করেছেন অভিযোগ তুলে গীতি আরা নাসরীন বলেন, যখন শপথ নেন, তখন পড়েন ভীতি, অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব। এ শপথ তো নিতে হয়। শপথ নিয়ে আপনারা শপথের মর্যাদা রক্ষা করেন না। আপনারা রাগ-বিরাগের বশবর্তী হইয়া হঠাৎ একসময় কোটা বাতিল করে দেন।

শিক্ষার্থীদের গুলি করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের দায়িত্বশীল এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বলবো- যাদের সঙ্গে আপনাদের হাসিমুখে কথা বলার কথা, যাদের বুকে জড়িয়ে ধরার কথা, সেই বুকে গুলি করেন আপনারা। একাত্তর যে সাহস আমাদের দিয়েছিল, আজকে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনও তা-ই দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজিবি মোতায়েনের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, এটা তো বাংলাদেশের সীমান্ত নয়, এখানে বিজিবির থাকার কথা নয়। যদি তারা এখানে আসেনও, তাহলে শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকতে হবে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের চলে যেতে বলতে পারেন না। শিক্ষার্থীরা যেটা চাইবে, সেটা করতে দিতে হবে। তাদের কোনো কিছুতে বাধ্য করবেন না।

আরও পড়ুন

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কোথাও আগুন কিংবা ভাঙচুর করেনি: ডিবিপ্রধান হল খালি করার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ শিক্ষকদের

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার হওয়া প্রয়োজন, এটা আমরা সবাই মনে করি। সরকারও এটা মনে করে। তাহলে এখানে সমস্যাটা কোথায়? শিক্ষার্থীদের মারতে হবে কেন? শান্তিপূর্ণভাবে এটার সমাধান করা খুবই সম্ভব ছিল। সেখানে খুবই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও।

ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন, সেটাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। বাহাত্তরের যে সংবিধান, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় চেতনার মধ্যে অন্যতম ছিল অসাম্য, বৈষম্যহীনতা, সুযোগের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। অথচ আজ অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামা শিক্ষার্থীদের রাজাকার ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। এটা আমরা শিক্ষকরা প্রত্যাখ্যান করছি।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর যেরকম আঘাত এসেছে, আমরা তো চুপ করে থাকতে পারি না। শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েরা তো আমাদের কাছেই ছেলে-মেয়েদের রেখেছে। এভাবে অরক্ষিত অবস্থায় তারা থাকবে, এটা তো আমাদেরও দায়। যদিও আমরা দেরি করে ফেলেছি, আরেকটু আগে করতে পারলে ভালো হতো। সংগঠিত হতেও আমাদের কিছুটা সময় লেগেছে।

সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তানজীম উদ্দিন খান, বেসরকারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক নোভা আহমেদ প্রমুখ। এছাড়া সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন।

এএএইচ/এমকেআর/জিকেএস